বিদায় নিলেন কমরেড অজয় রায়
এস.ইসলাম জয়: বাংলার মাটি, বাংলা জল / পূর্ণ হোক পূর্ণ হোক, হে ভগবান।এ গানটি ছিল অজয় রায়ের পছন্দের। তাই তিনি মিশে যেতে চাইতেন বাংলার মাটিতে। আর এজন্যই তার মরদেহ দাহ করতে নিষেধ করেছিলেন। বলেছিলেন তাকে সমাধিস্থ করতে। যাতে তিনি এ মাটিতেই মিশে যান। প্রয়াত কমিউনিস্ট নেতা অজয় রায়কে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়েছেন রাজনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক নেতাসহ সর্বস্তরের মানুষ। স্মৃতি চারণ করেছেন অনেকেই। আবেগ-আপ্লুত হয়ে বলছিলেন তার সহজ-সরল ও সাবলীল জীবনের গল্প।
গতকাল বুধবার সকাল ১০টা ১৪ মিনিটে শহীদ মিনারে প্রথমে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গার্ড অব অনার দেওয়া হয় অজয় রায়কে।
তার প্রতিষ্ঠিত সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন, সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদবিরোধী মঞ্চের নেতাকর্মীরা ছাড়াও জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, সাংস্কৃতিকমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, ড. কামাল হোসেন, ফজলে হোসেন বাদশা (এমপি), বিটিভির সাবেক মহাপরিচালক ম. হামিদ, সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দীলিপ বড়ুয়া প্রয়াতের কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।
কথা হয় সৈয়দ আশরাফের সঙ্গে তিনি বলেন, অজয় রায় ছিলেন আমার সংগ্রামের সঙ্গী। অমায়িক, দয়ালু এবং একজন শিক্ষিত মানুষ ছিলেন। আমার রাজনৈতিক পরামর্শক। রাজনৈতিকভাবে তার কাছে আমি অনেক কিছু শিখেছি। কোনো সমস্যায় পড়লে তার কাছে যেতাম। মাঝে মধ্যে এমনিতেই দেখা করতাম, গল্প হতো। গল্পের সময় মনেই হতো না আমি তার ছোট। আমার বাবাও তাকে ভালবাসতেন। সে অন্য দল করলেও তার প্রতি আমার শ্রদ্ধা ছিল অনেক গভীর। আমার জন্মের পরপর থেকে উনাকে ভালো করে দেখে আসছি।
তিনি আরও বলেন, ১৯৬৯ সালে ময়মনসিংহ জেলা কারাগারে বন্দি অবস্থায় জেলখানার চার তলায় দাঁড়িয়ে বাংলার মুক্তির সংগ্রামের কথা বলেছিলেন তিনি। আমরা কয়েকশ নেতাকর্মী সেই বক্তব্য শুনে উদ্বুদ্ধ হয়েছি। বক্তব্যের তীক্ষèতা এতই বেশি ছিল যে, এক ঘণ্টার মধ্যে পাকিস্তান সরকার তাকে জেল থেকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিল। তার পর উনাকে নিয়ে আমরা মিছিল করেছি পুরা শহরে। বাঙালির মুক্তির সংগ্রামে সব আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন প্রতিবাদী ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন , তিনি ছিলেন খাঁটি দেশ প্রেমিক, সাংস্কৃতিকপ্রেমি, বিরল মূল্যবোধের মানুষ। তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। ৮৮ বছর বয়সে তার মৃত্যুকে মনে হয়েছে অকাল মৃত্যু হয়েছে। দীলিপ বড়ুয়া বলেন, তিনি বিশুদ্ধ রাজনীতি করেছেন। রাজনীতিতে ভোগবাদী, সুবিধাবাদীদের সংমিশ্রণ ঘটাননি। শোষণমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক দেশের স্বপ্ন দেখতেন। ম. হামিদ বলেন, তরুণ প্রজন্মকে এক করতে পেরেছিলেন। তার শূন্যতা আমাদের নাড়া দিয়েছে। সে ছিল পথপ্রদর্শক।
প্রবীণ আইনজীবী ড. কামাল হোসেন বলেন, আদর্শ রাজনীতিবিদ, মেহনতী কৃষক, দিন-মজুরের দরদী মানুষ ছিলেন অজয় রায়। শোষণহীন, অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠনে জীবনভর সংগ্রাম করে গেছেন। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, অজয় রায় মানুষের কল্যাণের জন্য রাজনীতি করতেন। তাকে যে কোনো সংগ্রামে ডাকলে সাড়া দিতেন। ইরাক যুদ্ধে পল্টনের সমাবেশে তাকে ডাকার সাথে সাথে আমাদের মাঝে এসেছিলেন। আজ তার অভাব অনুভব করছি। বাসদের সাধারণ সম্পাদক সেলিনা হোসেন (এমপি) বলেন, বাংলাদেশে প্রগতিশীল রাজনৈতিক অবিভাবক ছিলেন তিনি। সে ছিল আদর্শ সমাজতান্ত্রিক কর্মী। তার কর্মনিষ্ঠা দিয়ে তা প্রমাণ করে গেছেন। জঙ্গিবাদ নির্মূলে তার অনুপ্রেরণা আমাদের চলার শক্তি হয়ে কাজ করবে। তবে তার শূন্যতায় আমাদের গুছিয়ে উঠতে একটু সময় লাগবে।
শোক বইয়ে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা (এমপি) লিখেন, শ্রেণীহীন শোষণ মুক্তির সংগ্রাম, অসম্প্রাদায়িক চেতনার প্রবাদ পুরুষ ,আজীবন সংগ্রামী কমরেড অজয় রায়, আপনাকে লাল সালাম। বাসদের রাজেকুজ্জমান রতন লিখেন, শোষণ মুক্তির স্বপ্ন নিয়ে সংগ্রামী মানুষ অজয় রায়। তার সংগ্রামী জীবনের প্রতি সালাম। ঢাকা সিটি কলেজের অধ্যাপক আরেফিন চৌধুরী লিখেন, প্রিয় অজয় দাদা তুমি মিশে যাচ্ছো এদেশের মাটিতে চিরদিনের জন্য। এ মাটিকে আমরা ধারণ করি অন্তরের গভীরে। তাই তুমিও চিরদিনের জন্য মিশে থাকবে আমাদের অন্তরে। আমাদের অস্তিত্বে। শ্রদ্ধা নিবেদন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন স্ত্রী জয়ন্তী রায়, ছেলে অমিতাভ রায় জয় ও মেয়ে অনিন্দিতা রায়।
অমিতাভ রায় আমাদের অর্থনীতিকে বলেন, কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদী উপজেলার বনগ্রামে পৈত্রিক বাড়িতে তার ইচ্ছা অনুযায়ী সমাধিস্থ করা হবে তাকে। আইনজীবী বাবার মৃত্যুর পর ১৯৪৪ সালে বাংলাদেশে ফিরে অর্থনীতিতে মাস্টার্স ডিগ্রি নেন অজয়। এরপর কিশোরগঞ্জের বনগ্রামে দাদার বাড়িতে ফিরে কমিউনিস্ট পার্টির কাজে সক্রিয় হন তিনি। পঞ্চাশের দশকে কমিউনিস্ট নেতা নগেন সরকার, ওয়ালী নেওয়াজ খান, মণি সিংহের সান্নিধ্যে আসেন অজয় রায়। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসে কেন্দ্রীয় সম্পাদক ম-লীর সদস্য নির্বাচিত হন।
সকাল ১১.১৪ মিনিটে শহীদ মিনারের বেদী থেকে চির বিদায় হয় কটিয়াদীর উদ্যেশে। বিদায় হন এদেশের মাটি ও মানুষের কাছ থেকে সমাধিস্থ হওয়ার জন্য।