আতিথেয়তা : সেবার অনন্য মাধ্যম
মাওলানা শাহ আবদুস সাত্তার
মানবিক গুণাবলির মধ্যে মানুষের সেবা, যতœ-আত্তি করা আতিথেয়তা, মেহমানদারি করা অন্যতম গুণ। চলমান জীবনে মানুষের বিভিন্নভাবে সেবা করা যায়। এর মধ্যে মেহমানদারির মরতবা যথেষ্ট। এ কারণেই পারিবারিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে এই গুণটির মর্যাদা অত্যন্ত তাৎপর্যবহ। তাই ইসলাম আতিথেয়তার গুরুত্ব দিয়েছে। মানুষকে তাগিদ দিয়েছে, উৎসাহিত করেছে এবং অতিথির সেবা, সম্মান করা, অতি আদরে আপ্যায়নের ক্ষেত্রে সবিশেষ নির্দেশ রয়েছে।
হজরত রাসূলে পাক সা. বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহপাক ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস রাখে, ইমান রাখে সে যেন মেহমানের প্রতি সেবা, সম্মানের প্রতি যতœবান হয়। পথিক অতিথি, মেহমানদের জন্য জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বেশেষে হজরত রাসূলে পাকের সা. দরজা ছিল সর্বদা উন্মুক্ত। মহানবীর সা. মেহমানদারিতে স্বধর্মী-বিধর্মীরাও ধন্য হয়েছে। আল্লাহর রাসূল সা. রাত জেগে জেগে পরিবারবর্গসহ অনাহারে থেকেও অতিথির সেবাযতœ করতেন। এতটুকু বিরক্তবোধ করেননি। বরং অতি খুশি, সন্তুষ্টি ও আনন্দচিত্তে মেহমানদের সেবা, যতœ ও আপ্যায়ন করতেন, এমনকি তিনি শত্রুকেও ঘরের শেষ খাদ্যটুকু পরিবেশন করে সারা রাত অনাহারে কাটিয়েছেন। অথচ তা কাউকে টের পেতে দেননি। মহানবীর সা. জীবনে এমনও ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে। হজরত রাসূলে পাক সা. বলেছেন, ক্ষুধার্তকে অন্ন দাও, পীড়িতকে সেবা, শুশ্রূষা করো, বন্দির মুক্তি দাও। আল্লাহর নবী সা. বলেছেন, যে ব্যক্তি নিজ সাধ্য-সামর্থ্য অনুযায়ী অতিথি ও মেহমানদের সমাদর, সেবাযতœ করে না, তার মঙ্গল নেই। এসব লোক বদ কিসমত।হজরত ইব্রাহিম আ. অতিথি ও মেহমানদের সন্ধানে অন্তত দু’মাইল হেঁটে যেতেন এবং কোনো মেহমান না পাওয়া পর্যন্ত তিনি নিজেও আহার করতেন না। হজরত আনাছ ইবনে মোবারক রা. দাওয়াত করে অতিথিদের সম্মানে সামনে খুরমা রেখে বলতেন, যে ব্যক্তি বেশি বেশি খেতে পারবেনথ একেকটি খুরমার আঁটির জন্য আশি দেরহাম করে সম্মানী প্রদান করব। খাবার শেষে সত্যি সত্যি তিনি আঁটি গুণে কথা অনুযায়ী সম্মানী প্রদান করতেন। সেকালে আরবের আতিথেয়তার ইতিহাস ভূবনবিখ্যাত ছিল। শত্রু-মিত্র যেই হোক না কেন, কোনো বিপদে-আপদে পথিক বা মেহমান কোনো বাড়িতে আশ্রয় নিলে গৃহস্বামী মেহমানকে আপ্যায়নের জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠতেন। বাড়ির কর্তা মেহমানের পরিশ্রান্ত, ক্লান্ত অবয়ব দেখে তার জন্য খানাপিনার সুব্যবস্থা করলেন, অতঃপর তার আরাম-আয়েশ, শোয়ার জন্য সুন্দরতম সাজগোজ করে দিতেন। সম্রাট শেরশাহ ও মোগল বাদশাহ আওরঙ্গজেবের সময় সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে পথিক ও মেহমানদের জন্য শানদার অতিথিশালা নির্মাণ করে রেখেছিলেন। এমনকি সেখানে মেহমান-পথিক, অতিথিদের থাকা, খাওয়া ও বিশ্রামের সুব্যবস্থা ছিল, সোনারগাঁয়ের সুলতান গিয়াসউদ্দীনের আতিথেয়তা ও মেহমানদারির কাহিনী আজও লোকমুখে প্রচলিত রয়েছে। তার দরবারে কোনো বিদেশি পথিক বা মেহমান এলে নিজে গিয়ে খবর নিতেন এবং তাদের যতœ-আত্তি করার তাগিদ দিতেন।
শুধু তাই নয়, পথিক ও অতিথিদের পথ-খরচা পর্যন্ত নিজ তহবিল থেকে দিতেন, যা আজও লোকমুখে জনগুংতি রয়েছে। অতএব পারিবারিক, সামাজিক জীবনে আতিথেয়তার গুরুত্ব অপরিসীম। মনে রাখতে হবে, উপযুক্ত অতিথি সেবা ও আপ্যায়ন না হলে আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সম্পর্ক পর্যন্ত সুগভীর হয় না।
লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ সিরাত মিশন