ট্রাম্প, ইমেইল কেলেঙ্কারি, ক্লিনটন ফাউন্ডেশনের দুর্নীতিতে জোর দিয়েছেন হিলারি বিতর্ক করেছেন ট্রাম্পের যৌনতার অভিযোগ নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বিতর্ক শেষ
বিশ্বজিৎ দত্ত : মার্কিন নির্বাচন উপলক্ষে আয়োজিত তৃতীয় ও শেষ বিতর্কের সমাপ্তি ঘটেছে। আমেরিকান ইউনিভার্সিটি ইতিহাসবিদ ইলেন লিচমেন, গত ত্রিশ বছর যার কথা বারবার সত্য হয়েছে, এবারো তিনি ১৮৬০ থেকে ১৯৮০ পর্যন্ত নির্বাচন পর্যালোচনা করে বলেছেন, ‘ট্রাম্প জিতবেন। যাই হউক ট্রাম্প বিতর্কে সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছেন, ক্লিনটন ফাউন্ডেশানের দুর্নীতি ও হিলারীর ই-মেইল কেলেংকারীর উপরে। যেখানে ড. ইউনূসের নামও রয়েছে। অন্যদিকে হিলারি জোর দিয়েছেন ট্রাম্পের বিরুদ্ধে উঠা যৌন অভিযোগের দিকে। ট্রাম্পকে প্রশ্ন করা হয়েছিলো, হেরে গেলে তিনি ফলাফল মানবেন কিনা? উত্তরে তিনি বলেছেন,
সময় এলে বলবো, এখন সাসপেন্সে রাখলাম। নির্বাচনের বাকি তিন সপ্তাহের কম সময়। ৮ নভেম্বর রাতে এর যবনিকা ঘটবে। বিতর্কের একেবারে শেষ পর্যায়ে ট্রাম্প তার প্রতিদ্বন্দ্বি হিলারীকে ‘ন্যাস্টি ওমেন’ বলে মন্তব্য করেন। এই দু’টো ঘটনা ছাড়া সর্বশেষ বিতর্কে ট্রাম ভালোই করেছেন। বরং হিলারী একটু নার্ভাস ছিলেন। লাস ভেগাসের নেভাদা ইউনিভার্সিটিতে অনুষ্ঠিত এ বিতর্ক মডারেট করেন ফক্স নিউজের সাংবাদিক ক্রিস ওয়ালেস। দেড়ঘন্টাব্যাপী সর্বশেষ বিতর্কে ট্রাম্প এবার বেশ ভদ্র ছিলেন। তৃতীয় বিতর্ক আগের দু’টোর মত ততটা হট ছিলো না। বিতর্কে বিচারপতি নিয়োগ থেকে, অস্ত্র সংবরণ; গর্ভপাত; ইমিগ্রেশন; অর্থনীতি; ক্লিনটন ফাউন্ডেশন; সিরীয় শরণার্থী; মহিলা ইস্যু, মসুলে চলমান যুদ্ধ, ঋণ কমানো; ট্যাক্স রিটার্ন এবং এমনকি প্রেসিডেন্ট হবার উপযুক্ততা আলোচনায় এসেছে। ইমিগ্রেশন প্রশ্নে ট্রাম্প আগের মতোই কঠোর ছিলেন। তিনি বলেন, নো বর্ডার, নো কান্ট্রি’। তিনি জানান, হিলারীও একদা ওয়ালের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। এক পর্যায়ে রাশিয়ার প্রসঙ্গ এলে হিলারি বলেন, রাশিয়া তাদের ‘পাপেট’ ট্রাম্পকে চায়। ট্রাম্প রেগে বলেন, ‘হিলারি মিথ্যাবাদী’। এ সময় বিতর্কে ‘নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড’ প্রসঙ্গও আসে। ট্রাম্প স্পটত:এমিনিস্টির বিরুদ্ধে বলেন। অর্থনীতি উজ্জীবনে হিলারি ভালো করেছেন। ট্রাম্প বলেছেন, হিলারি শুধু কথায় পটু, কাজে নয়। হিলারি বলেছেন, ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হলে দেশে আবারো অর্থনৈতিক মন্দা আসবে।
ক্লিন্টন ফাউন্ডেশন প্রশ্নে হিলারি একটু বেকায়দায় ছিলেন, যদিও তিনি এর প্রশংসা করেছেন। ট্রাম্প বলেছেন, সৌদি আরব বা অন্যান্য দেশ থেকে ক্লিনটন ফাউন্ডেশন যে অর্থ নিয়েছে, সেটা ফেরত দেবে কিনা? মসুল বা মধ্যপ্রাচ্য প্রশ্নে ট্রাম্প ওবামা-হিলারিকে ব্যর্থতার জন্যে দায়ী করেন। মোটামুটিভাবে বিতর্ক শালীন ছিলো এবং ভোটাররা এখন তাদের মনস্থির করবেন কাকে ভোট দেবেন। এই বিতর্কে কি কিছু হেরফের হবে? বলা মুশকিল। তবে ট্রাম্প সংযত ছিলেন। পূর্বাহ্নে তার কন্যা ইভানকা ট্রাম্প বাবাকে সংযত থাকার পরামর্শ দিয়েছিলেন। ট্রাম্প পতœী আবারো দৃঢ়তার সাথে ট্রাম্পকে সমর্থন জানিয়েছে বলেছেন, আমি যেই ট্রাম্পকে চিনি সেই ট্রাম্প মহিলাদের সন্মান জানাতে জানে। সমাপনী ভাষণে ট্রাম্প বলেছেন, ‘আই উইল মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন। হিলারি তাকে জয়ী করার জন্যে ভোটারদের কাছে ভোট চান।
নির্বাচন এখন দুয়ারে, ভোটের বাজার সরগরম। হিলারী এগিয়ে আছেন। সেক্স স্ক্যান্ডালে ডোনাল্ড ট্রাম্প বিপর্যস্ত। হিলারী রডহ্যাম ক্লিনটন ই- মেইল কেলেঙ্কারীতে ঠিক ততটা না হলেও যথেষ্ট বিব্রত। বিতর্কেও সেটা স্পষ্ট। ট্রাম্প সরাসরি হিলারীকে ই-মেইল নিয়ে আক্রমণ করছেন। ক্লিনটন একইভাবে ট্রাম্পকে ‘এন্টি-ওমেন’ দেখানোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। তৃতীয় বিতর্ক অনেকটা সুশীল থাকলেও বাইরের ভোটযুদ্ধ ততটা ‘সুশীল’ নয়, থাকবেও না। ডেমোক্রেটরা হোয়াইট হাউজসহ কংগ্রেস ও সিনেট নিজেদের দখলে নেয়ার জন্যে মরিয়া। রিপাবলিকানরা ট্রাম্পকে বাদ দিয়ে সিনেট ও হাউসে তাদের সংখ্যাগরিষ্টতা ধরে রাখতে সচেষ্ট। ট্রাম্প তার দলের অনেক নেতার বিরোধীতার সম্মুখীন হচ্ছেন। মিডিয়া ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আছে। প্রেসিডেন্ট ওবামা এবং ফার্স্ট লেডী মিশেল সরাসরি ট্রাম্পের বিরুদ্ধে নেমেছেন। এই যুগল ট্রাম্পের বেশ ক্ষতি করছেন। ফার্স্ট লেডী মিশেল ওবামা সদ্য বলেছেন, আমি বিশ্বাস করতে পারছি না যে, আমাকে একজন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীর মহিলাদের সাথে যৌন নির্যাতন নিয়ে কথা বলতে হচ্ছে, এটা লজ্জাস্কর এবং অসহ্য। এদিকে ওয়াশিংটন পোস্ট এবিসি/ পোষ্ট যৌথ জরীপের ফলাফল জানিয়ে বলেছে, দেশব্যাপী হিলারী ৪পয়েন্টে (৪৭-৪৩%) এগিয়ে আছেন এবং ভোটাররা বলছেন, ট্রাম্পের টেপ তাদের সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলেনি। পত্রিকাটি আরো বলছে, ৬৮% মনে করেন ট্রাম্পের বিরুদ্ধে মহিলাদের অভিযোগের সত্যতা আছে; ১৪% বলেছেন, সত্য নয়। ওই টেপকে ট্রাম্প ‘লকার রুম টক’ বলে মন্তব্য করেছিলেন, ৪০% ভোটার বলেছেন, হয়তো সেটি ঠিক, ৫২% বলেছেন, ঠিক নয়।
ইতিমধ্যে প্রায় ৯জন মহিলা ট্রাম্পের বিরুদ্ধে যৌনহয়রানীর অভিযোগ এনেছেন। ট্রাম্প সেক্স স্ক্যান্ডাল অভিযোগে বিব্রত। বিতর্কেও তিনি তা আবার অস্বীকার করেছেন। তার সবচেয়ে ক্ষতি করেছে ১১ বছর আগের রমরমা টেপটি। এতে ট্রাম্প একজন বিবাহিতা মহিলার সম্পর্কে বেশ রগরগা বর্ণনা দেন। ট্রাম্প এজন্যে ক্ষমা চেয়ে বলেছেন,আমার ভুল হয়ে গেছে। হিলারী বলেছেন, যিনি মহিলাদের এমন অপমান করেন তিনি প্রেসিডেন্ট হবার অযোগ্য। রিপাবলিকান নেতারা অনেকে তার সংস্পর্শ ছেড়েছেন। সেক্স স্ক্যান্ডাল মার্কিন নির্বাচনে এক উপাদেয় বিষয়। এরআগেও মিডিয়া ট্রাম্প পতœীর উদাম শরীরের ছবি ছেপে আলোড়ন তুলতে চেয়েছিলো। তবে এগার বছরের আগেরকার টেপটি প্রকাশিত হলে আমেরিকায় তোলপাড় ওঠে। এমনকি, রিপাবলিকানরা ট্রাম্পকে সরে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান। প্রতি চারজনে একজন ট্রাম্পের সরে দাঁড়ানোর পক্ষে মত দেন। কিন্তু ট্রাম্প বলেন, ‘প্রশ্নই ওঠে না। নিউইয়র্কের সাবেক মেয়র রুডি জুলিয়ানী বলেছেন, ‘প্রার্থিতা প্রত্যাহারের মত কিছু ঘটেনি। প্রায় সব রিপাবলিকান নেতা টেপটি’র নিন্দা করেছেন। ট্রাম্পের বিপক্ষে যেমনি কিছু মহিলা এগিয়ে এসেছেন, পক্ষেও মহিলারা কথা বলছেন, তাদের বক্তব্য, ‘পুরানো কাসুন্দি ঘেটে লাভ কি?
এদিকে ডেমোক্রেটরা ভাবছেন, তারা এবার হাউস বা কংগ্রেস রিপাবলিকান দখলমুক্ত করতে পারবেন। এজন্যে তাদের দরকার অতিরিক্ত ৩০টি আসন। মিডিয়া বলছে, এটি সম্ভব। রিপাবলিকানরা ভাবছে, তারা না হোয়াইট হাউস এবং কংগ্রেস দু’টোর দখল হারান। স্পীকার পল রায়ান এবং সিনেট নেতা মিচ ম্যাককোনেল এজন্যে ট্রাম্পকে ছেড়ে হাউজ/সিনেট রক্ষায় মন দিয়েছেন। আইসিস মুসলমানদের আহবান জানিয়েছে হিলারীর পক্ষে কাজ করার জন্যে। রাশিয়া প্রকাশ্যে কিছু না বললেও এরা ওবামা প্রশাসনের বিরুদ্ধে। মার্কিন কর্মকর্তারাও ভেতরে ভেতরে বলছেন, রাশিয়া মার্কিন নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারে সচেষ্ট। মার্কিন ভাইস- প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সাইবার আক্রমণের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা নেবেন বলে হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন।
এরআগে দ্বিতীয় বিতর্কে ট্রাম্প প্রতিপক্ষ হিলারীকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করে বলেছেন, নির্বাচিত হলে তিনি একজন স্পেশাল প্রসিকিউটর নিয়োগ দিয়ে হিলারীর ই-মেইল কেলেঙ্কারী তদন্ত করবেন। ট্রাম্প বলেন, হিলারীর জায়গা জেলখানায়। পাল্টা আক্রমণে হিলারী বারবার ২০০৫ সালের সেক্স টেপ প্রসঙ্গ টানেন এবং ট্রাম্প যে মহিলাদের প্রতি যাচ্ছেতাই ব্যবহার করেন সেই দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন। মিডিয়া বলছে, দ্বিতীয় বিতর্ক একটি কালো অধ্যায়ের সৃষ্টি করেছে। ট্রাম্প এক পর্যায়ে হিলারীকে ‘দি ডেভিল’ বলে আখ্যায়িত করেন। ওবামা শিকাগোতে তার ভোট দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রে কোন কোন স্টেটে আগাম ভোট দেয়ার সুযোগ রয়েছে। ওবামা সেই সুযোগ নিয়েছেন। ভোট দিয়ে তিনি বলেছেন, হিলারী জিতবেন। রবার্ট রাইখ নামে একজন নির্বাচন বিশ্লেষক এখনো বলছেন, হিলারীর জয় নিশ্চিত নয়। তারমতে, নির্বাচনটি এখনো অনির্ধারিত। হিলারী ৩-৪% এগিয়ে, যা ট্রাম্প কভার করতে পারবেন। কারণ, ট্রাম্পের উঠে আসার ঐতিহ্য আছে। লিবারেটেরিয়ান প্রার্থী গ্যারী জনসন হিলারীর ভোট কাটবেন। ৬৭% ডেমোক্রেট ভোটার ভোট দেবেন বলে মনে করা হচ্ছে; পক্ষান্ত ৭৬% রিপাবলিকান তাদের ভোট দেবেন। বর্তমান সময়ে মাত্র একবার একই দল তিন টার্ম ক্ষমতায় ছিলো। বিভিন্ন জরিপ ও বিশ্লেষকরা তা বলছেন না। ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস টাইমস শনিবার এক নিবন্ধে বলছে: ট্রাম্প বিপর্যস্ত। রয়টার/এলপিসওস জরীপ বলছে, হিলারী ৪৪%, ট্রাম্প ৩৭%। ফক্স নিউজ দেখাচ্ছে ৪৫-৩৮%। লস এঞ্জেলস টাইমস/ইউএসসি ট্র্যাকিং জরীপে ক্লিন্টন ৪৪% ট্রাম্প ৪৪%। রাসমুসেন জরীপ ক্লিন্টন ৪১%ট্রাম্প ৪৩%দেখিয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ স্টেটে ক্লিন্টন এগিয়ে। এডব্লিউবি/ইউআর জরীপ বলছে, নিউ হ্যাম্পশায়ারে ক্লিনটন ৪১-ট্রাম্প ৩৮%। ওহাইও, ভার্জিনিয়া, নর্থ ক্যারোলিনা, পেনসিলভানিয়া, বা ফ্লোরিডাতে ক্লিনটন সামান্য ব্যবধানে এগিয়ে রয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে জিততে হলে ট্রাম্পকে চমক দেখাতে হবে। ওয়াশিংটন পোস্ট ইলেকটোরাল ভোটের একটি চিত্র দিয়ে বলেছে হিলারীর ২৭৩টি ভোট রয়েছে। জয়ের জন্যে দরকার ২৭০টি ভোট। কে হচ্ছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। মার্কিনীদের ভাষায়, স্টে টিউনড। সম্পাদনা : শাহানুজ্জামান টিটু