ইয়েমেনে সৌদি হত্যাকা- এবং যুক্তরাজ্যের দৃষ্টিভঙ্গি
মোহসীন আব্বাস: মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক নিয়তিই যেন সংঘাত। কোথায় সংঘাত নেই এ অঞ্চলে? ইরাকে সংঘাত, সিরিয়ায় সংঘাত, ফিলিস্তিনে সংঘাত, সংঘাত ইয়েমেনে। এ সংঘাতের প্রভাবযুক্ত হামলা চলছে সৌদি আরবে, কুয়েতে। উপসাগরের আপাত শাস্ত আমিরাতগুলো বসবাস করে সংঘাত-হামলার ভয়ের বাতাবরণে।
এ সংঘাতকে কেন্দ্র করেই পশ্চিমা দুনিয়া এবং অপরাপর বিশ্বশক্তি ও অন্য অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ দেশের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক, কূটনৈতিক এবং সামরিক সম্পর্কের ধরন ও মাত্রা নির্ধারিত হয়।
মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমাদের বিশ্বস্ত মিত্র সৌদি আরব। সৌদি আরব একটি রাজবংশশাসিত দেশ। বাদশাহ এখানে দৃশ্যত একক ক্ষমতার অধিকারী হলেও কার্যত ক্ষমতা আবর্তিত হয় প্রিন্সদের জোটবদ্ধতার ওপর। বর্তমান বাদশাহর উত্থান হয়েছে প্রিন্সদের একটা বড় অংশকে কোণঠাসা করে, সমঝোতার মধ্য দিয়ে নয়। একথা প্রমাণ করতে এখনকার ক্ষমতাধরদের মাতৃবংশ পরিচয় এবং বাদশাহর সঙ্গে তাদের রক্ত সম্পর্কের ধরণ বিবেচনাই যথেষ্ট।
যুক্তরাজ্যের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। একদা মধ্যপ্রাচ্যে ব্রিটিশ রাজত্বকে সহযোগিতা করেছে সৌদ বংশ। ব্রিটিশবিরোধী বিদ্রোহেরকালে তারা ছিল আরবদের বিরুদ্ধে। তাদের এ ভূমিকা শেষ পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্যের বিশাল এলাকার বাদশাহ বানিয়ে দেয়। আরব অঞ্চল থেকে ব্রিটিশ বিদায় হয়, তেলসহ সকল খনিজসম্পদে ব্রিটিশ অধিকার শেষ হয় না। পৃথিবী সামনে চলে, অদলবদল হয় বিশ্ব রাজনীতিতে, সৌদি আরবের সঙ্গে ব্রিটেনসহ বিশ্বশক্তির ধরন পাল্টায়, স্বার্থটা থেকে যায় একইরকম।
সব শেষে মধ্যপ্রাচ্যে শুরু হয় যুদ্ধ-সংঘাতের রাজনীতি। এবার পশ্চিমা দুনিয়ার নেতা যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাজ্য তার অসহায় সমর্থক মাত্র। তারপরও ব্রিটিশ জনগণ বলে তো একটা কথা আছে। আর ব্রিটিশ নেতাদেরও রাষ্ট্র ক্ষমতায় যেতে হয় তাদেরই ভোটে। ফলে মাঝে মধ্যে মানবাধিকার, যুদ্ধাপরাধ ইত্যকার কিছু ইস্যুকে সামনে আনতে হয়। বেশ কবছর ধরে ইয়েমেনে বোমা ফেলে সৌদি আরব মানুষ মারছে নির্বিচারে। সম্প্রতি ইয়েমেনের এক শেষকৃত্যে বোমা ফেলে সৌদি সামরিক জোট। আর এতে করে সামান্য দোলা লাগে ব্রিটিশ হৃদয়ে। তারা শুরু করে এ ঘটনার আলাদা তদন্ত। এমনকি একজন মন্ত্রীকেও পাঠানো হয় রিয়াদে। এ ঘটনায় কমপক্ষে একশ চল্লিশ জন নিহত হয়, আহতের সংখ্যা পাঁচশরও বেশি। সৌদি কর্তৃপক্ষ এখনো এ ঘটনার দায় স্বীকার করেনি।
এ ঘটনা প্রবাহের দিকে নজর রেখে কূটনীতি বিশারদরা মনে করছেন যুক্তরাজ্য কি তবে সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্কের ধরন বদলাবে? যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র কি কেবল নিন্দার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে? না কি আরও কিছু দূর এগুবে?
যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে বড় অস্ত্র ক্রেতাদের একটি সৌদি আরব। আর ব্রিটিশ পার্লামেন্টে সবচেয়ে বড় সৌদি সমর্থক বলে পরিচিত সাংসদ হলেন টোবিয়াস এলউড। তিনি দেশটির পররাষ্ট্র দফতরের একজন বড় কর্তা। এলউড এখন চাচ্ছেন সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্কের স্পর্শকাতর বিষয়ে আলোচনা করতে। তিনি আলোচনা করবেন সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদেল জুবাইর এবং ইয়েমেনি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে। এছাড়া ইয়েমেন সম্পর্কিত জাতিসংঘ বিশেষ দূতের সঙ্গ্ওে তার আলোচনার কথা রয়েছে। আর এ উদ্যোগ তিনি নিচ্ছেন এ কারণে যে, একটি মাত্র হামলায় এত মানুষের প্রাণহানি কি করে হলো তা বোধগম্য নয়। আর যুক্তরাষ্ট্রের জনগণকে তো সরকারের পক্ষ থেকে সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্কের ধরন নিয়ে একটা ব্যাখ্যা দিতেই হবে।
অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন ইয়েমেনে যুদ্ধাপরাধ চলছে। আর যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র দফতর এখন এ কথা প্রমাণ করতে চাইছে যে, তারা সৌদি নেতৃত্বাধীন ইয়েমেনবিরোধী জোটের অংশ নয়। বাস্তবতা হলো সৌদি সামরিক বাহিনীর ব্যবহৃত বেশিরভাগ সমর সরঞ্জামই ব্রিটেনের তৈরি। আর যুক্তরাষ্ট্র ইয়েমেন সম্পর্কে গোয়েন্দা তথ্য দেয় সৌদি আরবকে। এ বিষয়ে সৌদি আরব বলছে তারা সশস্ত্র সংঘাতের সব আইন মেনে চলছে এবং তাদের কোয়ালিশনের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, সমস্যাটা এখানেই। অপরাধী অপরাধ তদন্ত করছে। আর ব্রিটিশ ডিফেন্স সেক্রেটারি স্যার মাইকেল ফেলন বলেন, একথা যদি প্রমাণিত হয় যে, সৌদি আরব ইচ্ছা করে বেসামরিক নাগরিক হত্যা করছে তবে যুক্তরাজ্য সরকার সৌদি আরবের সঙ্গে সামরিক সম্পর্ক পুনর্বিবেচনা করবে। আর সৌদি আরব প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এ বিষয়ে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হবে। তবে হুথি বিদ্রোহীরা একথা মানতে পারছে না। সন্দেহও দূর হচ্ছে না তাদের।
আস্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা এই যুদ্ধকে একটা ব্যর্থ সামরিক পদক্ষেপ বলে মনে করেন। ২০১৫ সালের মার্চ মাসে সৌদি আরব ১১টি দেশ নিয়ে একটি সামরিক জোট গঠন করে। শিয়া মতের মুসলিম বিদ্রোহীগোষ্ঠী হুথিদের দমনের লক্ষ্যে এ জোট গঠন করা হয়। ব্রিটেন-মার্কিন আধুনিক সমরাস্ত্র থাকা সত্ত্বেও হুথিদের দমন করা যায়নি। এ পর্যন্ত সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট যত হামলা চালিয়েছে তাতে বেসামরিক স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বেশি। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, নিহতদের ৬০ শতাংশই বেসামরিক নাগরিক। ইয়েমেনের বেশিরভাগ এলাকা হুথিদের দখলে। আগের শাসকরা ক্ষুদ্র একটা অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করে। এদের সহায়তা করছে সৌদি জোট। একটা অস্ত্র বিরতি চুক্তি হয়েছিল। তা বেশিদিন বলবৎ থাকেনি। যুক্তরাজ্যের নতুন উদ্যোগ কোনদিকে যায় সেদিকেই এখন লক্ষ্য রাখছে সকলে। বিবিসি অবলম্বনে