নির্বাচন কমিশন গঠনে নিরপেক্ষতাই মুখ্য
ইকতেদার আহমেদ
লেখক: সাবেক জজ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
বাংলাদেশ অভ্যুদ্বয় পরবর্তী ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দের মার্চ অবধি নির্বাচন কমিশন গঠনে সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারকদের প্রাধান্য ছিল। ৬ষ্ঠ সংসদ নির্বাচন পরবর্তী যে সকল নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে এর প্রতিটিতেই প্রধান নির্বাচন কমিশনার পদে অবসরপ্রাপ্ত সচিব পদধারীদের স্থান হয়েছে। এ সকল কমিশনে কমিশনার পদে অধস্তন বিচারবিভাগ, প্রশাসন ও সেনাকর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। দলীয় সরকারের অধীন গঠিত প্রতিটি নির্বাচন কমিশনের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, দলীয় নেতৃবৃন্দের আস্থাভাজন এবং দলীয় রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতি অনুগত এমন ব্যক্তি সকল সমন্বয়ে কমিশন গঠন করা হয়েছে। দলীয় বহির্ভূত সরকারের অধীন নির্বাচন কমিশন গঠনের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ, সৎ, দক্ষ, যোগ্য ও ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন ব্যক্তির সমন্বয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হলেও নির্বাচনে পরাভূত দল প্রতিটি কমিশনের ক্ষেত্রে বিজয়ীদের পক্ষাবলম্বনে পক্ষপাতদুষ্টতার অভিযোগ তুলেছে।
বাংলাদেশের নির্বাচনি ইতিহাসে দলীয় সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত প্রতিটি নির্বাচনে দলীয় সরকারের বিজয় লাভ ঘটেছে, অপরদিকে দলীয় বহির্ভূত সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত প্রতিটি নির্বাচনে নির্বাচনের অব্যবহিত আগে ক্ষমতায় আসীন দলীয় সরকার পরাভূত হয়েছে।
নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্বসমূহের অন্যতম হলো সংসদ সদস্যদের নির্বাচন অনুষ্ঠান, সংসদ নির্বাচনের জন্য নির্বাচনি এলাকার সীমানা নির্ধারণ এবং সংসদের নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা প্রস্তুত। নির্বাচন কমিশনের উপর ন্যস্ত উপরোক্ত দায়িত্ব পালনের জন্য নির্বাচন কমিশনের ব্যাপক জনবলের সেবা গ্রহণের আবশ্যকতা দেখা দেয়। নির্বাচন কমিশনের সীমিত জনবলের পক্ষে উপরোক্ত কার্যক্রম পরিচালনা সম্ভব নয় বিধায় নির্বাচন কমিশনকর্তৃক তার উপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালনের জন্য যেরূপ জনবলের প্রয়োজন হবে, নির্বাচন কমিশনের অনুরোধের প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশনকে সেরূপ জনবল প্রদানের ব্যবস্থা করবেন এমন নিশ্চিয়তা সাংবিধানিকভাবে কমিশনকে দেওয়া আছে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারগণ রাষ্ট্রপতিকর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হলেও তাদের নিয়োগ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ও আকাক্সক্ষাই মুখ্য। নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ বিষয়ে অদ্যাবধি কোনো আইন প্রণীত না হওয়ায় ইতোপূর্বে নবম সংসদ নির্বাচন পরবর্তী মেয়াদ অবসানের কারণে নির্বাচন কমিশন গঠনের আবশ্যকতা দেখা দিলে গঠন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার প্রলেপ দেওয়ার মানসে নির্বাহী আদেশবলে তিন সদস্যবিশিষ্ট সার্চ কমিটি গঠনপূর্বক প্রতিটি পদের বিপরীতে রাষ্ট্রপতি বরাবর দুটি নামের সুপারিশ প্রদানের নির্দেশনা দেওয়া হয়। সে নির্বাচন কমিশনে যাদের ঠাঁই হয়েছিল তারা অদ্যাবধি কর্মরত আছেন। এ নির্বাচন কমিশনের অধীন অনুষ্ঠিত জাতীয় ও স্থানীয় সংস্থার প্রতিটি নির্বাচনে ব্যাপক মাত্রার কলুষতা প্রত্যক্ষ করা গেলেও কমিশনকে সর্বদাই নির্বাক ও নির্লিপ্ত দেখা গেছে। এ কমিশনটির মেয়াদ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ পাঁচ বছর পূর্ণ হবে বিধায় একাদশ সংসদ নির্বাচন যে নতুন কমিশনের অধীন অনুষ্ঠিত হবে সেটি অনেকটা নিশ্চিত। ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশন গঠনের তোড়জোড় পরিলক্ষিত হচ্ছে। দেশের বড় দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বিরোধিদলে থাকাবস্থায় নির্বাচন বিষয়ে সুস্পষ্ট অবস্থান দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন সুষ্ঠু হয় না। জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিষয়ে সংবিধানের বর্তমান যে অবস্থান তাতে দশম সংসদ নির্বাচনের ন্যায় একাদশ সংসদ নির্বাচনও দলীয় সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। দশম সংসদ নির্বাচন বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম ও অস্বচ্ছতায় পরিপূর্ণ থাকায় এটি অভ্যন্তরীণভাবে দেশের ব্যাপক জনগোষ্ঠীর নিকট এবং আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। দশম সংসদ নির্বাচন যে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নয় তার প্রমাণ সম্প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও চীনের প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফরকালীন বিরোধিদলীয় নেত্রীকে সাক্ষাৎ না দিয়ে বিএনপির নেত্রীকে সাক্ষাৎ দেওয়ার মধ্যে পাওয়া যায়।
দশম সংসদ নির্বাচনের ন্যায় একাদশ সংসদ নির্বাচন অনিয়ম ও অস্বচ্ছতায় ভরপুর হলে তা এ দেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎসহ উন্নয়ন, সমৃদ্ধি, অগ্রযাত্রা ও স্থিতিশীলতাকে ব্যহত করবে। একাদশ সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে প্রাথমিক যে আবশ্যকতা তা হলোÑ স্বচ্ছ ভাবমূর্তির সৎ, দক্ষ, যোগ্য ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ব্যক্তি সমন্বয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন। বর্তমান আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন থাকাবস্থায় জ্যোষ্ঠদের অতিক্রান্ত করে যাদের উচ্চপদে আসীন করা হয়েছে, যাদের অবসর পরবর্তী এক বা দু’মেয়াদে স্ব-পদে অথবা সংবিধিবদ্ধ সংস্থার মেয়াদি পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, দলীয় রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতি অনুগত হিসেবে যাদের ব্যাপক পরিচিত রয়েছে এবং ব্যাপক দুর্নীতি করা সত্ত্বেও দলীয় অনুগত বিবেচনায় যাদের দুর্নীতি উপেক্ষিত হয়েছে এরা সকলে বর্তমান সরকারের সুবিধাভোগী। এরূপ কারও যদি আসন্ন নবগঠিত নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ ঘটে সেক্ষেত্রে তার পক্ষে যে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্বপালন সম্ভব নয় এটি অবধারিত। সুতরাং একাদশ সংসদ নির্বাচনের পূর্বে গঠিত নির্বাচন কমিশনে যেকোনো ধরনের বিতর্ক পরিহারে এ ধরনের ব্যক্তির নিয়োগ না হওয়াই উত্তম।
বাংলাদেশে ইতোপূর্বে উচ্চআদালতের অবসরপ্রাপ্ত যে সকল বিচারক নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ পেয়েছিলেন এদের কেউই কমিশনে আগমন পরবর্তী সকল ধরনের অনিয়ম ও বিতর্কের উর্ধ্বে থেকে নিরপেক্ষতা বজায় রেখে দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনে সফলতা দেখাতে পারেননি। এ কারণেই বিগত দুদশকে গঠিত কোনো নির্বাচন কমিশনে উচ্চআদালতের অবসরপ্রাপ্ত বিচারকের প্রবেশ ঘটেনি। এ সময়ের মধ্যে গঠিত বিভিন্ন নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে যাদের দেখা মিলেছে তারা প্রশাসন, অধস্তন বিচারবিভাগ ও সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। দলীয় সুবিধাভোগী নয় উপরোক্ত তিনটি বিভাগসহ অন্যান্য বিভাগে এমন অনেক ব্যক্তি রয়েছেন যাদের কর্মজীবন সব ধরনের কালিমা হতে মুক্ত। এরা একদিকে যেমন নিরপেক্ষ অপরদিকে সৎ, দক্ষ, যোগ্য ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। এরা বিনয়ী কিন্তু দৃঢ়। খুঁজে বের করে তাদের সমন্বয়ে নির্বাচন কমিশন গঠনের দায়িত্ব ক্ষমতাসীন সরকারের উপর বর্তায়। আর এ দায়িত্ব পালনে সরকার অত্যাবশ্যক মনে করলে প্রকৃত প্রধান বিরোধি দলের সঙ্গে আলোচনার সূত্রপাত ঘটাতে পারে; তবে যেকোনোভাবেই দলীয় সুবিধাভোগী ও দলীয় রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতি অনুগত ব্যক্তির কমিশনে প্রবেশ ঘটলে তাতে এর নিরপেক্ষতা যে ক্ষুণœ হবে এটি নিশ্চিত। প্রণিধানযোগ্য যে, উভয় দলের সুবিধাভোগী এবং উভয় দলের রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতি অনুগত ব্যক্তি সমন্বয়ে আনুপাতিক ভিত্তিতে কমিশন গঠন নিরপেক্ষতার পরিচায়ক তো নয়ই বরং কমিশনের সামগ্রিক কার্যকলাপে অসহনীয় ও অস্বস্তিকর পরিস্থিতির পদাঙ্ক।
সম্পাদনা: আশিক রহমান