১০ টাকা কেজি চাল : মহৎ কাজের করুণ পরিণতির শঙ্কা
জনগণের সেবার মানসিকতা নিয়ে সরকারি প্রশাসন যে কাজ করে না তার প্রমাণ তো আমরা প্রতিদিনের হয়রানি থেকে তীব্রভাবে উপলব্ধি করি। রাস্তা-ঘাট, বাজার-বিপণিতে অব্যবস্থাপনা ও অরাজকতা থাকলেও অফিস-আদালতের সর্বত্রই দেখা যায় নিয়ম-কানুনের কড়াকড়ি। অথচ সেখানে ফাইল নড়তে টাকা দিতে হয়। তবে এসব ক্ষেত্রে দুর্নীতির বিস্তারই কেবল হয়রানির সৃষ্টি করে না বরং তা হয়ে ওঠে প্রতারণার শ্রেষ্ঠ জায়গা। প্রশ্ন হচ্ছে, ডিজিটাল বাংলাদেশে কেবল যন্ত্র আর কাগজের মধ্যেই কি সব সেবা লুকিয়ে আছে। রাস্তার ফুটপাত কি চিরদিন দখলদারিত্বের কবলে থাকবে?
বিভিন্ন সংবাদের সূত্র থেকে আমরা জেনেছি, সরকারের বিভিন্ন দাপ্তরিক কাজ সম্পাদনের পাশাপাশি এবার কঠোর গোপনীয়তায় মন্ত্রীদের ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখছেন শেখ হাসিনা। কারণ, ‘গত সরকারের আমলে কয়েকজন মন্ত্রী-এমপি অস্বাভাবিক অর্থ-সম্পদের মালিক হওয়ায় সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী যেকোনো মূল্যে সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি এড়াতে চান।’ মনে রাখা দরকার, আমরা দুর্নীতির ¯্রষ্টাদের দুর্নীতিবিরোধী বয়ান শুনে শুনে আতঙ্কিত হয়েছি। এমনকি দুর্নীতি নিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বস্তরে অনেক মুখরোচক কথা চালু রয়েছে। কথাবার্তায় আমরা প্রায় সবাই দুর্নীতিবিরোধী হয়ে ওঠার চেষ্টা করি। কিন্তু দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে সামাজিক সচেতনতা তৈরি করা দরকার সেই প্রচেষ্টা গ্রহণ করি না। এমনকি দুর্নীতির নীতিগত উৎসাহদাতা অনেক আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা প্রায়-ই বলে থাকেন দুর্নীতির কারণে দেশের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আমাদের অবশ্যই দুর্নীতির ¯্রষ্টাদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। কারণ প্রতিনিয়ত মুক্তবাজার, বেসরকারিকরণ, বাজার উন্মুক্তকরণ, শিক্ষা-স্বাস্থ্যসহ সরকারি সেবাগুলোর ওপর ব্যক্তিমালিকানা প্রতিষ্ঠার জন্য উন্নয়ন সহযোগী আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান চাপ প্রয়োগ করছে। এমনকি রাষ্ট্রায়াত্ব প্রতিষ্ঠানসমূহকে অকার্যকর করার জন্য এবং দেশের রাজনীতিকে কলঙ্কিত করতে রাজনীতিবিদদের ক্রয়-বিক্রয়ে মেতে উঠছেন অনেকেইÑ এ সম্পর্কেও সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে। অনেক গবেষকই বলে থাকেন মুক্তবাজারের প্রতিযোগিতাকে অবাধ করার অর্থই হলো দুর্নীতিকে উৎসাহিত করা। মুক্তবাজার নিজেই দুর্নীতির ¯্রষ্টা, এটাকে বজায় রেখে যারা ব্যক্তি দুর্নীতিবাজ ধরার প্রচেষ্টা চালায়, তারা অনেকটা জল ঘোলা করে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের পথ খুঁজে ফেরেন। তারা চায় অর্থনৈতিক সক্ষমতায় দরিদ্র রাষ্ট্রগুলোতে নামমাত্র পুতুল সরকার বজায় রেখে বিশ্বব্যাপী ধনী রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব নিরঙ্কুশ করতে। ১/১১-এর সময় দেশ থেকে দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদদের হঠানোর যে হঠকারি আয়োজন হয়েছিল, সে ঘটনাও মনে রাখা দরকার। এছাড়া ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গড়ে তুলতে হবে এমনভাবে যেন তারা মনে না করে টাকা থাকলেই সমাজ সম্মান করবে। কারণ লেখাপড়ার উদ্দেশ্য যদি ভালো চাকরি পাওয়া হয় তাহলে সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে দুর্নীতি কখনো উচ্ছেদ করা সম্ভব নয়। সম্প্রতি ‘দুদক’ সাবেক মন্ত্রী ও বর্তমান সংসদের এমপিদের কয়েকজনকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। এতে সরকারের সদিচ্ছা প্রকাশ পেয়েছে। বিশেষত দিন বদলের চ্যালেঞ্জ নিয়ে সরকারের যাত্রা শুরু হয়েছে। মন্ত্রিসভার কোনো সদস্য অনিয়ম ও দুর্নীতি করলে প্রধানমন্ত্রী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেনÑ এ প্রত্যাশা আমাদেরও। কারণ বিগত মন্ত্রিসভায় যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে, তাদের এবার রাখা হয়নি। অতীতের অনিশ্চয়তা, সংকটের চক্রাবর্ত এবং অনুন্নোয়নের ধারা থেকে বের করে এনে প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শান্তি, গণতন্ত্র ও উন্নয়নের গতিপথে পুনঃস্থাপিত করা হোক বর্তমান সরকারের প্রধান লক্ষ্য।
৩. একটা ভিন্ন প্রেক্ষাপটে অনেক আশাবাদ নিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ২০১৪ সালে পুনরায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন শেখ হাসিনা। তার আগের জোট সরকারের আমলের রাষ্ট্রীয় ইতিহাস ছিল কলঙ্কিত। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের মন্ত্রী, এমপি এবং দলীয়/অঙ্গ/সহযোগী সংগঠনের দুর্নীতি, দৌরাত্ম্য দেশবাসীর জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। জোট সরকারের পাঁচ বছরের শাসনামলের পাঁচ বছরই টিআইবির রেটিংয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে কুখ্যাতি অর্জন করেছিল। উল্লেখ্য, দেশ পরিচালনায় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সামগ্রিক ব্যর্থতা, অদক্ষতা, দুর্নীতি, দলীয়করণ এবং ক্ষমতার অপব্যবহার উন্নয়ন ও অগ্রগতির ধারাকেই উল্টে দিয়েছিল। নস্যাৎ করে দেয় সব সম্ভাবনা। তারেক রহমানের উদ্যোগে গড়ে তোলা হয়েছিল রাষ্ট্রক্ষমতার সমান্তরাল বা বিকল্প কেন্দ্র ‘হাওয়া ভবন’। এই হাওয়া ভবন থেকেই ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা করে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। ‘হাওয়া ভবন’ হয়ে উঠেছিল সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, সিন্ডিকেট, চাঁদাবাজি ও কমিশন সংগ্রহ, প্রশাসনের নিয়োগ-বদলি, অবৈধ অস্ত্র ও মাদক ব্যবসা প্রভৃতি দেশবিরোধী অবৈধ কর্মকা-ে অঘোষিত হেড-কোয়ার্টার। মহাজোট সরকারের গত পাঁচ বছরে সেই দুর্নাম বহুলাংশে মোচন হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন পুনর্গঠন করেছে। দুর্নীতির তদন্ত, অনুসন্ধান, জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে দুদক প্রয়োজনে মন্ত্রী, আমলাসহ যেকোনো ক্ষমতাধর ব্যক্তিকে তলব করে জিজ্ঞাসাবাদের নজির স্থাপন করেছে। দুর্নীতি ও অনিয়মের উৎসমুখগুলো বন্ধ করার লক্ষ্যে অনলাইনে টেন্ডারসহ বিভিন্ন সেবাখাতে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে দুর্নীতির সর্বগ্রাসী প্রকোপ কমেছে।
দুর্নীতি প্রতিরোধে ও রাষ্ট্রপরিচালনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবদানই অনন্য। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দীর্ঘ সংগ্রামের চালিকাশক্তি ছিল একটি সুখী, সমৃদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ সমাজের স্বপ্ন। কিন্তু রাষ্ট্রের ৪৩ বছরের ইতিহাসে সেই স্বপ্ন বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে, পথভ্রষ্ট হয়েছে এবং মুখ থুবড়ে পড়েছে। জাতির পিতার শাহাদাত, সামরিক শাসন এবং স্বৈরাচারী, গণবিরোধী ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির ক্ষমতা দখল জনগণের সেই স্বপ্নের বাস্তবায়নকে বারবার দূরে সরিয়ে দিয়েছে। জনগণের জীবনে এ ধরনের শাসনের কুফল প্রতিফলিত হয়েছিল অনুন্নোয়নে, বৃহৎ জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের অবদমনে, রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনায়, দুর্নীতিতে এবং সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে শুদ্ধাচারের অভাবে। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে জনগণের বিপুল ম্যান্ডেট নিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণের পর আওয়ামী লীগ সরকার এই দুঃশাসনের বিরুদ্ধে, অব্যবস্থার বিরুদ্ধে এবং রাষ্ট্রীয় দুর্নীতির বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল। এই যুদ্ধকে শেখ হাসিনা চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও তার শাসনামলে একই ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিলেন। ১৯৭৪ সালের ২৫ ডিসেম্বরে জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘… সুখী ও সমৃদ্ধিশালী দেশ গড়তে হলে দেশবাসীকে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়াতে হবে।
লেখক: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পাদনা: আশিক রহমান