জঙ্গিবাদে আসক্তি কি মানসিক রোগ?
আপাত দৃষ্টিতে এমনটি মনে হওয়া স্বাভাবিক যে অল্প সময়ে কাউকে এমনভাবে ‘ব্রেইনওয়াশ’ করা কীভাবে সম্ভব, পিপড়ে মারতে মায়া লাগত যে ছেলের, কয়েক মাসের ব্যবধানে সে-ই জবাই করে, কুপিয়ে নির্দ্বিধায় বিভৎস্য উপায়ে মানুষ হত্যা করতে কুণ্ঠাবোধ করে না। এমনটি তো সুস্থ, স্বাভাবিক মস্তিষ্কের কাজ হতে পারে না।
তবে পাশ্চাত্যের গবেষণালব্দ তথ্য অনুযায়ী সন্ত্রাসী-জঙ্গিরা মানসিক রোগী নয়। তারা প্যারানয়েড নয়, তারা ডেলুশনাল নয়। সমাজবিজ্ঞানী স্টিফেন ডি রিচার বলেন, ‘জঙ্গিরা সাইকোপ্যাথ নয় বা স্যাডিস্ট নয় (যা আমরা মনে করে থাকি)। তাদের বেশির ভাগ সাধারণ মানুষের মতো।’
প্রশ্ন হচ্ছে, স্বাভাবিক মানুষ এমন জঘন্য, নিষ্ঠুর কাজ করতে পারে? মনোবিজ্ঞানী বান্দুরা বলেন, ‘যথাযথ সামাজিক পরিবেশ থাকলে শোভন, মার্জিত আচরণের সাধারণ মানুষ ও অচিন্তনীয় বর্বরতা দেখাতে পারে’। তাই উচ্চ শিক্ষিত, উচ্চ পরিবার, খুবই ভালো মানুষগুলো কেন জঙ্গি হয়ে যাচ্ছে সেটি ভেবে বিস্মিত হওয়ার কারণ নেই।
অন্যদের সঙ্গে তাদের পার্থক্য হচ্ছে, ‘নিজেদের লক্ষ্য ও বিশ্বাসের প্রতি তারা এত একনিষ্ঠ যে, অন্যদের প্রতি সমব্যথী মনোভাবটি হারিয়ে ফেলে’। তারা যাদের বিরুদ্ধে লড়ছে তাদেরকে ‘বস্তু’ হিসেবে দেখে বা ‘গোষ্ঠী’ হিসেবে, ‘ব্যক্তি মানুষ’ হিসেবে নয়। এ ব্যাপারে উল্লেখ করা যেতে পারে, এক সময়ে নকশাল আন্দোলনে জোতদার, জমিদারদের কল্লা কাটার তত্ত্ব, সর্বহারা বাহিনীর মানুষ হত্যা, এমনকি সাম্প্রতিক পূর্বতন বিডিআরের সাধারণ, সুস্থ সৈনিকরা কি আর্মি অফিসারদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেনি? যেকোনো ভাবাদর্শে দীক্ষিত হলে বা অধিকার আদায়ে সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হলে, লড়াইয়ের কৌশল হিসেবে যা করণীয় তারা তা করতে পিছপা হন না।
এক. ‘রিলিজিয়াস ডেলুশন’ বা ‘রিফর্মিস্ট ডেলুশন’-এর সঙ্গে বর্তমানের ধর্মীয় জঙ্গিবাদের পার্থক্য কোথায়?
ইধৎঁশ রিফর্মিস্ট ডেলুশন কথাটি চালুু করেন। রিফর্ম হচ্ছেÑ সমাজ, রাষ্ট্রে সংস্কার সাধন করা। আর ডেলুশন হচ্ছে, মন-মস্তিষ্কে গভীরে প্রোথিত ভ্রান্ত বিশ্বাস, যা কোনো যুক্তি বা প্রমাণ দিয়ে খ-ন করা যায় না। রিফর্মিস্ট ডেলুশন ধর্মীয়, দার্শনিক বা রাজনৈতিক মতবাদকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে পারে। তবে এ ধরনের ডেলুশন ডায়াগনসিস করতে হবে সাইকিয়াট্রিক ব্যাকগ্রাউন্ড বিবেচনা নিয়ে, কোনোভাবেই রাজনৈতিক বিবেচনা দিয়ে নয়। প্রধাণত ব্যক্তি বিশেষ বিচ্ছিন্নভাবে এ রকম ডেলুশনে আক্রান্ত হতে পারে। দুই. জঙ্গি আসক্তি ও মাদক আসক্তির মধ্যে কি মিল আছে?
আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি এ দুটি বিষয়ের মধ্যে অনেক মিল রয়েছে (যদিও একটি মানসিক রোগ, অন্যটি আপাত দৃষ্টিতে তেমনটি নয়)। মিলগুলো হচ্ছেÑ এক. এই উভয় আসক্তিই কিশোর-তরুণদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। দুই. উভয় ক্ষেত্রেই তারুণ্যের ঔৎসুক্য, অ্যাডভেঞ্চার, সঙ্গী-সাথীদের প্রভাব (পিয়ার প্রেসার), এক্সপেরিমেন্টেশন, সার্চ ফর নভেলটি ইত্যাদি নিয়ামক ভূমিকা হিসেবে কাজ করে।
লেখক: অধ্যাপক ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা
সম্পাদনা: আশিক রহমান