টিকে থাকবে কি থাইল্যান্ডে রাজতন্ত্র
মোহসীন আব্বাস: থাইল্যান্ড এখন কার্যত রাষ্ট্রপ্রধানশূন্য। রাজা ভূমিবলের মৃত্যুর পর এ শূন্যতার তৈরি হয়। তার মৃত্যুতে এক বছরের শোক ঘোষণা করে থাই সরকার। আর যুবরাজ মাহা ভাজিরালঙ্করণ জানান, শোককালে তিনি অভিষিক্ত হতে চান না। এমন পরিস্থিতিতে রাজপ্রতিভূ এখন ভরসা। শেষ পর্যন্ত রাজপ্রতিভূ নির্বাচিত হয়েছেন রাজা ভূমিবলের ঘনিষ্ঠ সাবেক সেনাপ্রধান ও প্রধানমন্ত্রী প্রেম তিনসুলানন্দ।
এমন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মধ্যে একটা প্রশ্ন জেগেছেÑ থাইল্যান্ডে রাজতন্ত্র কি অপসৃয়মান? এ প্রশ্নের রেশ ধরে আসে আরও একটি প্রশ্নÑ রাজা ভূমিবলই কি দেশটির শেষ রাজা?
প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে দেখতে হবে থাইল্যান্ডের চলমান রাজনীতি এবং রাজতন্ত্রের ইতিহাস। থাইল্যান্ডে এখন সেনাশাসন। দেশটিতে কিছুদিন আগে নতুন সংবিধান সম্পর্কিত একটি গণভোট হয়েছে। ভোটে জিতেছে সেনাশাসকদের প্রস্তাবিত খসড়া সংবিধান। যে সংবিধানে রয়েছে আইনসভায় নির্বাচিত প্রতিনিধির চেয়ে মনোনীত প্রতিনিধির সংখ্যাধিক্য। এ খসড়া সংবিধান এখন চূড়ান্ত অনুমোদন ও কার্যকর হওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। আর এই সংবিধান কার্যকর করতে হলে দরকার রাজার অনুমোদন।
প্রকৃত অর্থে থাইল্যান্ডের রাজনীতি আবর্তিত হয় দুটি রঙকে ঘিরে। লাল ও নীল। লাল রঙের সমর্থক রাজনীতিকরা রাজতন্ত্রের বিরোধী বা ততটা জোরালো সমর্থক নন। আর নীল রঙের সমর্থক রাজনীতিকরা সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের সমর্থক। তাদের অর্থনৈতিক নীতি, রাজনীতি-দর্শন প্রায় অভিন্ন। তার পরও বিরোধ চরমে। বিরোধ কেবল রাজতন্ত্র নিয়ে নয়। আশরাফ-আত্রাফবিষয়ক ইস্যুও আছে। লালের সমর্থক গ্রামের মানুষ, শহুরে শ্রমজীবীÑ যারা প্রধানত জীবিকার সন্ধানে গ্রাম থেকে এসেছে। আর মধ্যবিত্তের সেই অংশ লালের সমর্থক যারা এখনো ছুটিতে গ্রামে যায়, এখনো গ্রামে রয়ে গেছে তাদের যোগসূত্র। নীলের সমর্থকরা অভিজাত। তারা ক্ষমতা কাঠামোর গভীরে বিচরণ করে। তাদের চারপাশে আছে শহুরে মধ্যবিত্ত ও মেট্রো-ব্যাংককে জন্ম নেওয়া ও বেড়ে ওঠা শ্রমজীবী মানুষ।
এই দুই রাজনৈতিক ধারার বিরোধের সুবিধা সবসময়ই নিয়েছে সামরিক বাহিনী। বিশ্বযুদ্ধোত্তর থাইল্যান্ডবাসী বহুবার রাজনৈতিক বিরোধে জড়িয়েছে আর প্রবেশ করেছে দীর্ঘ সামরিক শাসনে। বেশ কবার জনতার মুখোমুখি হয়েছে সামরিক বাহিনী। তখন রাজাই ছিলেন ভরসার জায়গাÑ যিনি দুপক্ষকে রক্তারক্তি কা- থেকে নিবৃত করেছেন। থাইল্যান্ডে রাজা ভূমিবল ছিলেন ঈশ্বরের ছায়া। মানুষ তাকে শ্রদ্ধা করত ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবেই।
থাই রাজার এই ভাবমূর্তি গড়ে তোলা হয়েছে ধীরে ধীরে। আগে রাজারা এতটা শ্রদ্ধা-আত্তি পেতেন না।
থাইল্যান্ডের রাজারা ঐতিহাসিকভাবে শ্যাম রাজা হিসেবে পরিচিত। রাজা এখানে দেশ, সশস্ত্রবাহিনী, বিচার ও যাজক সংঘের অভিভাবক। বর্তমান রাজতন্ত্রের উদ্ভব হয়েছে আটশ বছরের বিবর্তন-পরিবর্তনের পথ ধরে। এর মধ্যে রাজতন্ত্রবিরোধী আন্দোলনও হয় দেশটিতে। এর পর ১৯৩২ সালে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের প্রবর্তক ছিলেন বিদেশে লেখাপড়া করা লোকজন যাদের নিজেদেরও অভিজাততান্ত্রিক ধারাবাহিকতা বা মনোভাব ছিল। সাংবিধানিক রাজতন্ত্র নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্রের অবসান ঘটায়। রাজা ভূমিবল সিংহাসনে আরোহণ করেন ১৯৪৬ সালে, তার ভাইয়ের অস্বাভাবিক ও বিতর্কিত মৃত্যুর পর। তখন তিনি স্যুইজারল্যান্ডে লেখাপড়া করছিলেন। শোকের মধ্যেই তিনি অভিষিক্ত হন। আর তার ছেলে শোকের বছরে অভিষিক্ত হতে চাইছেন না।
রাজা ভূমিবল কমপক্ষে দুবার দেশকে রক্ষা করেছেন রক্তক্ষয়ী রাজনৈতিক সংঘাত থেকে। তিনি, তার পরিবার ও তার অভিজাত বন্ধুরা অক্লান্ত চেষ্টায় রাজাসনকে ঈশ্বরের প্রতীক হিসেবে গড়ে তুলেছেন।
রাজা ভূমিবলের মৃত্যুর পর সেনা সরকারের প্রধানমন্ত্রী কয়েকজন প্রতিনিধিসহ দেখা করতে যান যুবরাজের সঙ্গে। ফিরে আসেন শোকের ঘোষণা এবং শোকের মধ্যে রাজাভিষেক না হওয়ার ঘোষণা নিয়ে। তবে রাজপ্রতিভূ হিসেবে নির্বাচিত হন রাজা ভূমিবলের ঘনিষ্ঠ জেনারেল প্রেম তিনসুলানন্দন। এ তিনটি বিষয় থাইল্যান্ডের রাজনীতির অন্দর মহলের টানাপড়েনের নির্দেশক।
যুবরাজের ভাবমূর্তি তার পিতার মতো নয়। প্রচলিত আছেÑ ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে তিনি লাল শার্টদের নীতিকে সমর্থন করেন। এমনকী ক্ষমতাচ্যুত ইংলাক সিনাওয়াত্রার ঘনিষ্ঠ বলে ধরা হয় যুবরাজকে। আর রাজা প্রতিভু ঈশ্বরের ছায়ারূপে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তার বাবাকে। তিনি লাল শার্টদের বিরোধী হলেও রাজতন্ত্রের বিরোধী নন। এখন যে ধারা থাই ক্ষমতা কাঠামোকে নেতৃত্ব দিচ্ছে তারা রাজতন্ত্রের সমর্থক। তবে জনসমর্থনের দিক থেকে পিছিয়ে। সামরিক শক্তির ছায়ায় তারা এমন এক সংবিধান কার্যকর করতে যাচ্ছে তাকে কোনো মতেই গণতন্ত্রের ধারক বলা যাচ্ছে না। এমন সংবিধানকে পশ্চিমের মিত্র দেশগুলো ভালো চোখে দেখছে না। যুক্তরাষ্ট্র হয়তো এখনি তেমন উচ্চবাচ্য করবে না। কেননা চীনবিরোধী মিত্র হিসেবে পূর্ব এশিয়ায় থাইল্যান্ডকে তাদের দরকার। আর দেশটি তাদের পরীক্ষিত বন্ধু। রাজনীতির কূটচাল বিবেচনায়, থাইল্যান্ডে রাজতন্ত্র আর কোনো প্রভাবক ভূমিকা রাখার অবস্থানে নেই। আবার ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের সময়ও পার হয়নি। এই দোলাচলের শেষ দেখতে বিশ্ববাসীর অপেক্ষা করতে হবে এক বছর। সম্পাদনা : হাসিবুল ফারুক চৌধুরী