নন-ক্যাডারপ্রাপ্ত তরুণদের আর্তনাদ শুনবে কে?
মিল্টন বিশ্বাস
আমাদের ছাত্র ফারদিন দীর্ঘ সাত বছরে তিনবার বিসিএস পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়ে প্রতিবারই ‘নন-ক্যাডার’-এ দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরি পেয়েছে। কিন্তু পদের জন্য আবেদন করা থেকে বিরত থেকেছে। কারণ ক্যাডার পাওয়া তথা প্রথম শ্রেণির চাকরি তার স্বপ্ন। এজন্য চরম হতাশা মনের ভিতর লালন করেও বারবার বিভিন্ন পরীক্ষায় অবতীর্ণ হচ্ছে একটি সরকারি চাকরির ভালো পদ পাওয়ার জন্য। অথচ তার চেয়ে যোগ্যতায় কম কিন্তু একই প্রক্রিয়ায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের অনেকেই প্রথম শ্রেণির চাকরি পেয়েছে বা পাচ্ছে। কম যোগ্যতা বলতে আমি তাদের মেধার অবমূল্যায়ন করছি না কিন্তু তদবির করে ক্যাডার পাওয়ার প্রসঙ্গটির দিকে দৃষ্টি দিচ্ছি। উল্লেখ্য, ফারদিন বাংলা বিভাগের ছাত্র হলেও ইংরেজি ভাষা জ্ঞান তার যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রিধারী ব্যক্তির চেয়ে বেশি। সে লিখতে ও বলতে সক্ষম ইংরেজিতে। আর পরিশ্রম করে দিনের পর দিন বিসিএসের শেষ ধাপে পৌঁছানোর ধৈর্যও তার অপরিসীম। কিন্তু বর্তমানে সে হতাশ। কারণ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হতে ইতোমধ্যে তার সরকারি চাকরির বয়স শেষ। আর কোনো সরকারি চাকরিতে আবেদন করার সুযোগ নেই তার। আবার নন-ক্যাডারে দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরি পেলেও তাতে ওর সন্তুষ্টি থাকছে না। এভাবে ফারদিনের মতো কয়েক হাজার তরুণ যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও কিংবা বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়েও ভালো পদ লাভে বঞ্চিত হচ্ছে। বিষয়টি সরকারের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এবং পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি) জানলেও দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে তারা আন্তরিক নন বলে নানা মাধ্যমে সংবাদ পাওয়া গেছে।
‘নন-ক্যাডার’ প্রাপ্তরা নিজেদের বঞ্চিত মনে করছে। ৩৫তম বিসিএসে যারা এই অবস্থার শিকার তারা নিজেদের হতাশা প্রকাশ করার সুযোগ পাচ্ছে না। নিজেদের মনের দুঃখ ফেসবুকে লিখে শেয়ার করছে। কিন্তু সরকারের কোনো একটা তরফ থেকে সান্ত¡নার বাণী পাচ্ছে না। তারা বলতে চাচ্ছে, কষ্ট করে বিসিএসের প্রাথমিক, লিখিত ও শেষে মৌখিক পরীক্ষাÑ এই তিন ধাপে যোগ্যতা প্রদর্শন করেও পিতা-মাতার মুখে হাসি ফোটাতে পারছে না। উপরন্তু আছে বিভিন্ন স্তরের কোটা বা সংরক্ষিত পদের সংখ্যা। ফলে নন-ক্যাডার থেকে প্রথম শ্রেণির পদ পাওয়া বেশ কঠিন। ৩৫তম বিসিএসে ২০০ নম্বরের প্রিলিমিনারিতে অংশগ্রহণ করে প্রায় আড়াই ল পরীার্থী। তার মধ্যে পিএসসি ১০ থেকে ২০ হাজারের মতো পরীার্থীকে লিখিত পরীার সুযোগ দেয়। দ্বিতীয় ধাপে ৯০০ নম্বরের আবার কেউ কেউ ১১০০ নম্বরের লিখিত পরীায় অংশগ্রহণ করে। লিখিত পরীায় উত্তীর্ণ হয় ৬ থেকে ১০ হাজারের মতো। ৩৫তম বিসিএসে লিখিত পরীায় মাত্র ৬,০৮৮ জন উত্তীর্ণ হয়; তাদের তৃতীয় তথা সর্বশেষ ধাপে ২০০ নম্বরের মৌখিক পরীার জন্য ডাকা হয়। সেখানে পাস করে ৫,৫৩৩ জন পরীার্থী। তাদের মধ্যে ২,১৫৮ জনকে বিভিন্ন ক্যাডারে সুপারিশ করা হয়; বাকি ৩৩৫৯ জনকে রাখা হয় ‘নন-ক্যাডার’ তালিকায়। এভাবে তিনটি ধাপে মোট ১,৫০০ নম্বরের পরীায় পাস করে কেউ হাসে; আবার কেউ কান্নাভরা বুকে অশ্রুজলে ভাসে। অনেকে ক্যাডার হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়; আবার কারও ভাগ্যে জোটে নন-ক্যাডার নামক তকমা। তাদের মধ্যে অনেকে ‘নন-ক্যাডার’ হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়; আবার অনেকে হয় বঞ্চিত।
দুই. চলতি বছর (২০১৬) প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, বর্তমানে প্রজাতন্ত্রের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও অধিদপ্তরসমূহে শুধু ‘প্রথম শ্রেণি’র ৩৯,০০০ (ঊনচল্লিশ হাজার) আর দ্বিতীয় শ্রেণির ৪০,০০০ (চল্লিশ হাজার) মতো পদ শূন্য। নন-ক্যাডার প্রাপ্ত তিন হাজার তরুণ কি শূন্য থাকা ৩৯,০০০ (ঊনচল্লিশ হাজার) পদের মধ্যে থেকে একটি করে চাকরি পাওয়ার যোগ্য নয়? আমরা এও জানতে পেরেছি, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অধিদপ্তরসমূহ বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনকে সাড়া দিচ্ছে না। অর্থাৎ মন্ত্রণালয়গুলো পিএসসিতে চাহিদা না পাঠানোয় বিসিএস উত্তীর্ণ বিপুলসংখ্যক প্রার্থী নিয়োগ পায়নি। সরকারের মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অধিদপ্তরসমূহের এ ধরনের আচরণের কারণই বা কি? অথচ নন-ক্যাডার থেকে নিয়োগেয় জন্য ২০১০ সালের ১০ মে প্রজ্ঞাপন করে ‘নন-ক্যাডার বিধিমালা-২০১০’ জারি করা হয়। এতে বলা হয়েছে, শূন্য পদের ৫০ শতাংশ বিসিএসে উত্তীর্ণ প্রার্থীদের দিয়ে পূরণ করা হবে। পরবর্তী বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশের আগ পর্যন্ত আগের বিসিএস থেকে নিয়োগ চলবে। ২০১৪ সালে এই বিধি সংশোধন করে প্রথম শ্রেণির নন-ক্যাডার পদের পাশাপাশি দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা পদেও নিয়োগের ব্যবস্থা রাখা হয়। কিন্তু এরপরও চাকরি পাচ্ছে না সবাই। এত কষ্ট করে বিসিএস পরীা দিয়ে উত্তীর্ণ হয়ে চাকরি না পাওয়া দুঃখজনক। ৫০ শতাংশ পদে বিসিএস উত্তীর্ণদের নিয়োগ দেওয়ার বিধি করা হলেও মন্ত্রণালয়গুলো চাহিদা দিতে আগ্রহী থাকে না। ফলে অধিকাংশই নিয়োগ পায় না। ‘নন-ক্যাডার বিধিমালা’র বিষয়টি আশাব্যঞ্জক হলেও চাকরি প্রার্থীরা হতাশায় নিমজ্জিত এখনো।
বাংলাদেশ সংবিধান অনুযায়ী, রাষ্ট্রের প্রতিটি নারী-পুরুষ চাকরির েেত্র সমান সুবিধা লাভ করবে। শিক্ষিত তরুণরা যোগ্যতা সত্ত্বেও সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অথচ বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) প্রতিটি বিসিএসের চূড়ান্ত ফলাফল দেওয়ার সময় ‘পদ স্বল্পতা বা শূন্য পদের সংখ্যা কম’ থাকায় সকলকে ক্যাডার হিসেবে সুপারিশ না করে নন-ক্যাডারে সুপারিশ করে। এখানে চাকরি প্রার্থীদের প্রশ্ন, শূন্য পদের সংখ্যা কম বা পদের স্বল্পতা হলে কিভাবে পিএসসি পরবর্তী বিসিএসের আয়োজন করে? কেন পূর্বের বিসিএসে চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণদের সৃষ্ট ওইসব শূন্য পদে নিয়োগ প্রদান করে না? পিএসসি যখন ফলাফল ঘোষণা করে তখন হয়তো পদ সংখ্যা কম থাকে কিন্তু পরবর্তীতে পদ সৃষ্টি হলে কেন তাদেরকে ক্যাডার হিসেবে সুপারিশ না করে আরেকটি বিসিএস পরীা গ্রহণের সময় ঘোষণা করে? এতে কি সরকারি অর্থ আর সময়ের অপচয় হচ্ছে না? যারা ৩৫তমের আগের পরীায় উত্তীর্ণ হলো তারা কীভাবে নিশ্চয়তা পাবে যে, পরবর্তী বিসিএসে তারা আবার ২০০ নম্বরের প্রিলিমিনারি, ৯০০ নম্বরের লিখিত এবং ২০০ নম্বরের মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে? তাছাড়া এত পরিশ্রম আর অধ্যবসায়ের পর যদি ক্যাডার হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত না হয়, তাহলে তাদের মানসিক অবস্থা কেমন হয় তা কেবল নন-ক্যাডার হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত ব্যক্তিমাত্রই জানে। মরার উপর খাড়ার ঘা হয় যখন নন-ক্যাডার থেকেও একটি চাকরি না জোটে। বিগত দুটি বিসিএসে ফারদিন, খোরশেদ আলমসহ অনেকের ক্ষেত্রে এমনটিই হয়েছে। প্রতিটি নন-ক্যাডারধারী চাতক পাখির মতো তাকিয়ে থাকে পিএসসির ওয়েবসাইটের দিকে। বিসিএসে উত্তীর্ণ নন-ক্যাডার সবার প্রথম শ্রেণির চাকরি নিশ্চিত করার দাবি উঠেছে। এজন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পদ শূন্য থাকার পরও পিএসসিতে তারা চাহিদাপত্র দেয় না বলে অধিকাংশ নিয়োগ বঞ্চিত থাকে বলে যে অভিযোগ রয়েছে তার সুরাহা করতে হবে। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যারা ক্যাডার হয়েছে তারা নন-ক্যাডারদের চেয়ে বেশি মেধাবী, এটা অস্বীকার করছি না, কিন্তু নন-ক্যাডাররা যে একটা প্রথম শ্রেণির যোগ্যÑ সেটাও সবাইকে মানতে হবে। ৩৫তম বিসিএসের মাধ্যমে উত্তীর্ণ যোগ্য নন-ক্যাডার প্রাপ্ত তরুণদের প্রথম শ্রেণির পদে নিয়োগ প্রদান করলে দেশের আপামর জনগণের দৈনন্দিন সরকারি সেবা পাওয়া যেমন সহজ হবে পাশাপাশি ওই যুবকদের অনেকেরই লালিত স্বপ্ন সত্যি হবে। অনেকে বেকারত্বের করুণ দশা থেকে মুক্তি পাবে। উপকৃত হবে দেশ। তাই একদিকে বাড়বে সরকারের সুনাম, অন্যদিকে কমবে সরকারি অর্থের অপচয়।
তিন. শেখ হাসিনার সরকার নন-ক্যাডারদের নিয়োগে যুগোপযোগী ‘নন-ক্যাডার বিধিমালা’ প্রণয়ন করেছে। এজন্য আমরা ৩৫তম বিসিএস পরীায় চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ ৩,৩৫৯ জন নন-ক্যাডারদের সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ‘প্রথম শ্রেণি’ চাকরির জন্য আবেদন জানাচ্ছি। যুবসমাজ প্রথম শ্রেণির চাকরি পেলে, বিসিএস পরীায় চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হয়েও ক্যাডার হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত না হওয়ায় যে হতাশা, কষ্ট, মানসিক যন্ত্রণায় দিনযাপন করছেÑ তা অনেকাংশে কমে আসবে। অনেকের আকাক্সিক্ষত স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে; তাদের পরিবার-পরিজন পাবে আশার আলো। অনেক স্বপ্ন, উৎসাহ, উদ্যম আর উদ্দীপনা নিয়ে বিসিএস পরীায় অংশগ্রহণ করে চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হয়েও চাকরি না পাওয়া সত্যিই দুঃখজনক ঘটনা। বিসিএস পরীক্ষায় যোগ্যরাই কেবল উত্তীর্ণ হয়। তাই সরকারের কাছে আমাদের আহ্বান, যোগ্যতা আর নির্ঘুম অধ্যবসায়ের সঠিক মূল্যায়ন করবেন এবং ক্যাডারদের মতো ‘নন-ক্যাডার’দের প্রথম শ্রেণির পদে নিয়োগ প্রদানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে তরুণদের হতাশামুক্ত জীবনে বিচরণের সুযোগ করে দিবেন। আপনাদের সহযোগিতায় তাদের জীবনে আগামী দিনের যে সূর্য উঠবে তা প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মেলবন্ধনে সুন্দর হবে, নিজের দিকে নতুন করে তাকানোর সুযোগ ঘটবে।
লেখক: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পাদনা: আশিক রহমান