চাঞ্চল্যকর মিতু হত্যা হত্যার নেপথ্য নায়ক মিতুর বাবার ছত্রছায়ায়
আজাদ হোসেন সুমন ও মাসুদ আলম: মেয়েকে খুন করে তার বাবা সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মোশাররফের আশ্রয়ে বহাল তবিয়তেই দিন কাটাচ্ছেন সাবেক এসপি বাবুল আক্তার। তিনি নিজ স্ত্রীকে ভাড়াটে খুনী দিয়ে হত্যা করিয়েছেন। বিষয়টি এখন পুলিশ প্রশাসনে কারো অজানা নেই। এ সংক্রান্ত অপ্রকাশিত তথ্য চট্টগ্রাম গোয়েন্দা পুলিশের কাছে আছে।
বাবুল ও তার সোর্স মুসার কলামিস্ট ও কথোকপনের রেকর্ড রয়েছে পুলিশের কাছে। কিন্তু মিতুর বাবা বাবুলের অন্ধভক্ত। তিনি বিশ্বাস করেন না বাবুল আক্তার তার মেয়েকে হত্যা করেছে। অবশ্য হত্যার নেপথ্য ঘটনাও জানতে বা প্রকৃত হত্যাকারীর বিচারেও তাকে এ পর্যন্ত আগ্রহী হতে দেখা যায়নি।
গতকাল এ প্রতিবেদকের এক প্রশ্নের জবাবে মিতুর বাবা বলেন, বাবুল আক্তার আগের মতই আছেন খাচ্ছেন, ঘুমাচ্ছেন, নামাজ পড়ছেন আর বাচ্চাদের নিয়ে সময় কাটাচ্ছেন।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানাগেছে, বাবুল আক্তার নিজেই তার স্ত্রী মিতুকে খুনের সিদ্ধান্ত নেন। এই খুনের দায়িত্ব দেন তার দীর্ঘদিনের সোর্স মুসাকে। মুসা বাবুল আক্তারের স্ত্রীকে চিনতেন না। বাবুল এ সুযোগটি কৌশলে কাজে লাগায়। তিনি মুসাকে বলেন, একজন মহিলা জঙ্গি তৎপরতায় লিপ্ত। সে প্রতিদিন ছেলেকে নিয়ে স্কুলে যায়। ওইসময় তাকে খুন করতে হবে। তা না হলে চট্টগ্রামে জঙ্গি তৎপরতা বেড়ে যাবে। এই খুনের জন্য সরকারের তরফে ৭ লাখ টাকা পুরস্কার দেয়ারও প্রলোভন দেখানো হয় সোর্স মুসাকে।
সে মোতাবেক ঘটনার ১৫ দিন মুসা নিজ বাসায় তার পরিচিত ভাড়াটে কিলার ওয়াসিম, নবী, আনোয়ার, এহতেশাম ভোলা, শাহজাহান, কালু ও মনিরকে নিয়ে মিতুকে হত্যার পরিকল্পনা করে। কিলিং মিশনে কার অবস্থান কোথায় হবে এবং কে প্রথম হিট করবে সে সম্পর্কেও মুসা দিক-নির্দেশনা দেন কিলার গ্রুপটিকে। বৈঠক শেষে হাত খরচ হিসেবে প্রত্যেক কিলারকে নগদ ২ থেকে ৩ হাজার টাকা দেন মুসা। অপারেশনের পর মোটা অঙ্কের টাকা দেওয়া হবে বলে জানান মুসা। ভোলা নামের একজন আর্মস স্মাগলারের কাছ থেকে মুসা আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহ করে কিলার গ্রুপটিকে দেয়। খুনের আগের দিন সকালে মুসা ঘটনাস্থল রেকি করে। এরপর ৫ জুন রোববার খুনের দিনণ ঠিক করে কিলাররা। পরিকল্পনা চূড়ান্ত করার পর মুসা ৪ জুন শনিবার রাত আড়াইটায় ঢাকায় বাবুল আক্তারের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে। ওইসময় বাবুল আক্তার অন্য সেল ফোন ব্যবহার করে, এসময় মুসা কিভাবে মিতুকে হত্যা করবে তার একটি ছকও বাবুল আক্তারকে জানান। বাবুল আক্তার ‘ঠিক আছে’ বলে লাইন কেটে দেন। এরপর পরিকল্পনা অনুযায়ী ৫ জুন মিতুকে হত্যা করার পর মুসা বাবুল আক্তারকে মোবাইল ফোনে অপারেশন সফল হওয়ার কথা জানিয়ে দেয়। বাবুল আক্তার এসময় ‘ওকে’ বলে ফোনের লাইন কেটে দেন।
ঘটনার সময় চট্টগ্রাম মহানগর বন্দর থানার ওসি মহিউদ্দিন সেলিম ব্যক্তিগত কাজে সিঙ্গাপুরে ছিলেন। তিনি দেশে ফেরার পর পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাকে ডেকে পাঠান। মহিউদ্দিন সেলিম দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রাম বেল্টে ওসি’র দায়িত্ব পালন করেছেন। অপরাধ জগতের অনেক হোতাকেই তিনি চিনতেন। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ওসি মহিউদ্দিন সেলিমকে খুনিদের শনাক্ত করে গ্রেফতার করার দায়িত্ব দেন। এরপরই মহিউদ্দিন সেলিম মাঠে নামেন। ২১ জুন বন্দরনগরী থেকে প্রথম আটক করা মূল হোতা মুসাকে। তার আটকের ঘটনাটি এসপি বাবুল আক্তার জানতে পারেন। তিনি মুসাকে ছেড়ে দেয়ার জন্য ওসি মহিউদ্দিন সেলিমকে বলেন। এসময় মহিউদ্দিন সেলিম বাবুল আক্তারকে জানান, ‘স্যার, আমি একটি অভিযানে ব্যস্ত আছি, আপনাকে পরে ফোন দিচ্ছি। পরে মুসাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে মিতুর কিলার গ্রুপের সদস্য নবী, আনোয়ার, ওয়াসিম, মনির, এহতেশামুল ভোলাসহ অন্যদের ধরা হয়।
মুসাসহ অন্যান্য গ্রেফতাররা চট্টগ্রাম গোয়েন্দা পুলিশকে জানায়, তারা এসপি বাবুল আক্তারের নির্দেশে মিতুকে খুন করেছে। এসব জানার পরই পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ের কর্তাব্যক্তিরা বৈঠকে বসেন। সরকারের নীতি নির্ধারক মহলকেও ঘটনাটি জানানো হয়। পুলিশের ওই বৈঠকে পর্যালোচনা করা হয় এসপি বাবুল আক্তারের ঘটনাটি জনসমে প্রকাশিত হলে পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে সরকারও বিব্রতকর অবস্থায় পড়বে। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে বাবুল আক্তারকে হত্যার দায় থেকে মুক্তি দিয়ে তাকে পুলিশ বাহিনী থেকে বের করে দিতে হবে। এরপরই গত ২৪ জুন মধ্যরাতে বাবুল আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গোয়েন্দা দফতরে নেয়া হয়।
সেখানে তিনজন ডিআইজি পদমর্যাদার পুলিশ কর্মকর্তা মিতু হত্যায় তার জড়িত বিষয়ে তাদের কাছে প্রমাণ থাকার কথা জানান। এসময় ডিআইজিরা বাবুল আক্তারকে বলেন, স্ত্রী হত্যায় তার জড়িত থাকার বিষয়ে তাদের কাছে পর্যাপ্ত তথ্য প্রমাণ রয়েছে। এরপর তাকে পুলিশ বাহিনী থেকে সরে যেতে অন্যথায় জেলে যাওয়ার প্রস্তাব করা হয়। এসময় বাবুল আক্তার পুলিশ বাহিনী ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা জানালে তাকে পুলিশের ডিসির গাড়িতে করে খিলগাঁও থানাধীন মেরাদিয়ায় তার শ্বশুরবাড়িতে পৌঁছে দেয়া হয়। ২৬ জুন চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম হারুন অর রশিদের আদালতে ওয়াসিম ও আনোয়ার যে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে সেখানে তারা দুজনেই বলেছে, জঙ্গি অপবাদ দিয়ে তাদের ওই মহিলাকে খুন করানো হয়েছিলো। তারা জানতেন না নিহত মহিলা এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী।
গতকাল মিতুর বাবা মোশাররফ আরও জানান, বাবুল আক্তার এখন বেকার মাঝে মধ্যে বাইরে যান। তিনি প্রাইভেট জব করার চিন্তা করছেন বলে জানান সাবেক এই পুলিশ কর্মকর্তা। সম্পাদনা: সুমন ইসলাম