জয়ের অপেক্ষায় বাংলাদেশ
হাবিবুর রহমান তাপস
লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা, জাবি
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ উপমহাদেশের একটি প্রাচীন রাজনৈতিক দল। গণতন্ত্রমুখি ঐতিহ্যবাহী এই দলটি ২০তম সম্মেলনে সাফল্যের সঙ্গে আগামী ৩ বছরের জন্য তাদের নেতৃত্ব নির্বাচিত করে প্রমাণ করল, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমান নেতৃত্ব দেওয়া দলটি দিকভ্রষ্ট হয়নি। দলটির প্রাণশক্তি হচ্ছেÑ সংগঠনের প্রতি প্রান্তিক পর্যায়ের কর্মী-সমর্থকদের অকৃত্রিম ভালোবাসা। স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে বিশেষ করে ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকা-ের পর যতবারই এই দলটি বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে, ততবারই রক্ষা করেছেন ওই তৃণমূল পর্যায়ের সাধারণ কর্মী-সমর্থক গোষ্ঠী। প্রান্তিক পর্যায়ের এই মানুষগুলোর নিঃস্বার্থ ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে দলের হাল ধরেছেন, তাদের ভাষায় ‘শেখের বেটি হাসিনা’। সম্মেলনের সময়ে তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের এই ভালোবাসার উপযুক্ত সম্মান দিলেন জাতির জনকের কন্যা। মঞ্চে বসে ধৈর্য্য ধরে একের পর এক স্থানীয় পর্যায়ের নেতাদের মতামত শুনলেন। কোনো এমপি বা মন্ত্রীর বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ এবারের সম্মেলনে ছিল না। সারাদেশ থেকে আসা কাউন্সিলরদের নতুন নেতা নির্বাচিত করার তাগিদ দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। কিন্তু তারা তা করেননি। তাদের আস্থা একমাত্র শেখ হাসিনা। বাধ্য হয়ে দলের দায়িত্ব গ্রহণে সম্মতি দিলেন তিনি। সারাবিশ্বের মানুষ সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছে, সাধারণ কর্মী-সমর্থকেরা তাকে কি পরিমাণ ভালোবাসে। এই আস্থা তিনি অর্জন করেছেন ৩৭ বছর ধরে দলের ভার গ্রহণ করে। তিলে তিলে তিনি গড়েছেন এই কর্মীবাহিনী। এবারের সম্মেলনে বিদায়ী কমিটির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফকতৃক নতুন সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নাম প্রস্তাব ছিল একটি বড় চমক।
সাংগঠনিক দক্ষতা প্রমাণে শেখ হাসিনা এতটাই বিচক্ষণতার পরিচয় দিলেন যা সত্যি বিরল ঘটনা। তার পরিবারের সদস্যরা ক্ষমতার খুব কাছাকাছি থেকেও এর থেকে নিরাপদ দূরত্বতা বজায় রেখে চলেছে। যা অন্যান্য রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর কাছে শিক্ষাণীয় বিষয়। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া তার সন্তান তারেক রহমানকে অপরিপক্ক অবস্থায় রাজনীতিতে টেনে এনে যে অদূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন, তার খেসারত বিএনপি এখন দিচ্ছে। অল্প বয়সে ক্ষমতা পেয়ে কা-জ্ঞানহীন আচরণ ও সীমাহীন দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়েছিলেন তিনি। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়েই হোক আর নিজ উপলব্ধিতে হোক উপযুক্ত করে গড়ে তুলেই তিনি সজীব ওয়াজেদ জয়কে রাজনীতিতে আনবেন। এটাই আপাত দৃষ্টিতে বলে মনে হচ্ছে। তাছাড়া তিনি তো ফুরিয়ে যাননি। দেশকে তার দেবার এখনো অনেক কিছুই আছে। দেশ পরিচালনায় অভিজ্ঞতা একটি বড় বিষয়। প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ বিদেশ ভ্রমণে অথবা চুক্তি স্বাক্ষরে জয়কে তিনি সঙ্গে রাখছেন। তার অভিজ্ঞতার ঝুলি বাড়ছে, এটাইবা কম কিসের? রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে কোন পরিস্থিতিতে কি ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে হবে মায়ের পাশাপাশি থেকে তিনি সেটা ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করে রাখছেন। ১৯৮১ সালের শেখ হাসিনা আর বর্তমানের শেখ হাসিনা এক নয়। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন বিপদের সময়গুলোতে অনেক কাছের মানুষগুলোর বিরূপ আচরণ। পক্ষান্তরে তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের ভালোবাসা পেয়ে তিনি হয়েছেন সাহসী। হয়তো তিনি সন্তানকে শেখাচ্ছেন, আজকে যাদের তুমি চারপাশে দেখছ, বিপদের দিনে এদের কারও দেখাই পাবে না। আবেগী মায়ের সন্তান জন্মসূত্রেই তো আবেগী হবার কথা। রাষ্ট্র পরিচালনায় আবেগকে প্রকাশ্যে নয় বরং ভিতরে ধারণ করতে হয় এটা জেনেই হয়তো তিনি সন্তান ও দেশের মঙ্গলের জন্য আরও কিছু সময় নিলেন। মুঘল সম্রাট বাবর সময়ের প্রয়োজনে মাত্র বারো বছর বয়সে সিংহাসনে আসীন হয়েছিলেন। অপরিপক্ক বয়সে সিংহাসনে বসার কারণে তিনি কাছের মানুষগুলোর ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলেন। তার নিজের চাচা অনবরত তাকে সিংহাসনচ্যুত করবার ষড়যন্ত্র করেছিলেন, তার অনেক শত্রুও ছিল। একসময়ে তারা সফলও হয়েছিলেন। সেরকম কোনো পরিস্থিতি নিশ্চয়ই এখনো উদ্ভব হয়নি। অতি উৎসাহীরা কিছুটা চাটুকরও বটে। সন্তানের জন্য মায়ের থেকে মঙ্গল কামনা আর কে করতে পারে? মায়ের নেওয়া সিদ্ধান্তটি সঠিক হয়েছে।
২০তম জাতীয় সম্মেলনের পর এই দলটির সামনে রয়েছে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ। এর মধ্যে স্বাধীনতা অর্জনের পঞ্চাশ বছর পালন, জাতির জনকের শতবর্ষ পালন এবং যে ২০১৯ সালে গণতান্ত্রিক পন্থায় দেশের সব দলের অংশগ্রহণের নিমিত্তে একটি বিতর্কহীন, শান্তিপূর্ণ ও মুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠান। আর এই চ্যালেঞ্জগুলো সাফল্যের সঙ্গে উদ্যাপন করতে হলে ক্ষমতায় থাকাটা জরুরি। স্বাধীনতার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া এই দলটি চাইবে জনগণের আস্থা নিয়ে ক্ষমতার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে। আর তাই জনগণের আস্থা অর্জন করতে সম্মেলনে আগত কাউন্সিলরদের জনগণের কাছে যাবার দিকনির্দেশনা দিলেন দলের নেত্রী শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনা শুধু বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেত্রীই নন। তিনি এখন পুরো এশিয়ার একজন শক্তিশালী রাষ্ট্রনায়ক। বিশ্বের বুকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন রোল মডেল হিসেবে গণ্য। সবার মুখেই এখন বাংলাদেশের প্রশংসা। এই কথাগুলো অন্য কারও নয়, বলেছেন সম্মেলনে আসা রাশিয়া, আমেরিকা, চীন, ভারতসহ বিশ্বের ১১টি দেশ থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ। সবাই এক বাক্যে স্বীকার করেছেন, বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে চলেছে। সম্প্রতি ঘুরে যাওয়া জাতিসংঘের মহাসচিব ও বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টের মুখেও বাংলাদেশের উচ্চ প্রশংসা শোনা গেছে। তাদের সবার কাছে একই প্রশ্নÑ কীভাবে আন্তর্জাতিক সাহায্য ছাড়াই বাংলাদেশ এত বড় বড় সব প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এর সবটাই সম্ভব হয়েছে শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বের কারণে। বিশ্বব্যাংকের সাহায্য ছাড়াই নিজস্ব তহবিলের মাধ্যমে পদ্মাসেতুর কাজ শুরু হয়েছে। একের পর এক উড়াল সেতু নির্মাণ, মেট্রোরেল প্রকল্প গ্রহণ, গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্র বন্দর নির্মাণ, বিদ্যুৎ সেক্টরে অভূতপূর্ব উন্নয়ন, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অর্থনৈতিক জোন প্রকল্প গ্রহণ, আইটি সেক্টরে বড় বড় প্রকল্প গ্রহণ, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের কাজ শুরু, হতদরিদ্রদের মাঝে দশ টাকা দরে চাল বিক্রয় ইত্যাদি সবই আওয়ামী লীগ সরকারের অবদান। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এবারের সম্মেলনে বেশকিছু সাংগঠনিক নতুন সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। এর মধ্যে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে পদপ্রার্থী বাছাই সংক্রান্ত, সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ, কমিটির সদস্য পদ বৃদ্ধিসহ বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ নীতি গ্রহণ করা হয়।
আগামী জাতীয় নির্বাচনকে মাথায় রেখে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা নেতা-কর্মীদের এলাকায় ফিরে হতদরিদ্র মানুষের তালিকা করবার নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে করে তারা সরকারি সাহায্য-সহযোগিতা পায়। দলীয় সরকারের এই সিদ্ধান্তই বলে দিচ্ছে, দারিদ্র্য বিমোচনে সে কতটা আন্তরিক। শেখ হাসিনা তার বক্তব্যে দারিদ্র্য বিমোচন ও দুর্নীতির ব্যাপারে তার কঠোর অবস্থানের কথা উল্লেখ করেন। বিশ্বের বড় বড় দেশ এখন বাংলাদেশকে উদাহরণ হিসেবে গণ্য করে। শত সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ যেভাবে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হচ্ছে, তাতে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আকৃষ্ট হয়ে এদেশে বিনিয়োগে উৎসাহিত হচ্ছেন। সম্প্রতি চীন প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সফরে এসে বাংলাদেশকে দুই হাজার চারশো কোটি ডলার ঋণ সহযোগিতা করার ঘোষণা দিয়েছেন। ভারতীয় কোম্পানি রামপালে বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রাথমিক কাজ শুরু করেছে। জাইকা বাংলাদেশের রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ নির্মাণে ব্যাপক ভূমিকা পালন করছে। এই সবই বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের অবদান। আর এই ধারাবাহিকতা রক্ষাকল্পে দলীয় নেত্রী নেতা-কর্মীদের জনগণের দোরগোড়ায় যাবার তাগেদা দিলেন। জনগণ খুশি থাকলে তারা পুনরায় আওয়ামী লীগকে নির্বাচিত করবে। সম্মেলনে আগত হাজার হাজার নেতা-কর্মীদের সম্মতি নিয়ে নেতা নির্বাচন করে শেখ হাসিনা প্রমাণ করলেন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে। আরও প্রমাণ করলেন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে আরও বেশি শক্তিশালী।
সম্পাদনা: আশিক রহমান