আমরা কি বোবা কালা জাতিতে পরিণত হয়েছি?
অজয় দাশগুপ্ত
এমন এক পরিবেশ তৈরি হয়েছে মনে হবে, দেশে রাজনীতির বাইরে সমস্যা বা সম্ভাবনা বলে আর কিছু নেই। থাকলেও গৌণ। এই রোগ এখন মহামারি। এ নিয়ে বলতে চাই না। বলব সামাজিক সমস্যার কথা। খেয়াল করবেন, আমরা যতই বলি না কেন রাজনীতিতে মিল নেই, ঐক্য নেই, আসলে কিন্তু আছে। ভালো কাজে থাক বা না থাক খারাপে আছে। এত ধর্ষণ, এত নারকীয় হত্যা, এত ধরনের নারী নির্যাতন তারপরও কিন্তু কোনো রাজনৈতিক দলের দিক থেকে দেশ কাঁপানো কোনো প্রতিবাদ নেই। কদিন আগে বাচ্চা একটি মেয়েকে ধর্ষণ করা হয়েছে। পুজা নামের এই শিশুটি আসলে একটি প্রতীক। সে জানিয়ে দিয়েছে, আমাদের পুরুষরা এখন লিঙ্গপ্রধান। যৌনতার জন্য তারা শিশুকেও ছাড় দিতে রাজি না।
প্রতিবাদের জায়গাটা দিনকে দিন দুর্বল থেকে দুর্বল করেছি আমরাই। এক একটা ঘটনা বা দুর্ঘটনা আসলে কারও কারও জন্য আশীর্বাদ। তাদের ডাক পড়ে নানা চ্যানেলে। কাগজে লিখে, ওয়েবে লিখে হাইপ্রোফাইলের মানুষ হয়ে ওঠে কেউ কেউ। এত বিশ্লেষণ, এত সারগর্ভ ভাষণ আর বাণী শুনতে শুনতে ক্লান্ত জনগণ পাশ ফিরে ঘুমায়। চেনাকিছু মুখ দু’চারটে কাগজের ব্যানার আর হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে বলে, করেছি তো। মানববন্ধন করেছি। এই ধারাবাহিকতায় ধর্ষক বা হত্যাকারী বুঝে গেছে ওদের কেশ স্পর্শেরও সুযোগ নেই কারও। সমাজে এমন অসহায়ত্ব আগে দেখিনি আমরা। কোথায় সেই মানুষেরা? যারা বলবেন, এত ধর্মাচারণ পোশাকে, আহারে, এতটা ধার্মিক হবার পরও কেন আজ এই দানবীয় পরিবেশ চারিদিকে? কারণ না আছে প্রতিরোধ, না রাজনীতির কোনো উদ্যোগ।
গত কদিন ধরে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলের বাইরে আর কোনো খবর পাত্তাই পায়নি। গণতান্ত্রিক সমাজ কি এই একপেশে আচরণ ও অভ্যাস অনুমোদন করে? তারা সরকারে আছেন বলে তাদের কোন নেতা, কখন কয়টায় টিভি ক্যামেরার সামনে হাজির হবেন, তার বাড়িতে কে তাকে মালা পরাল এসবও জানতে হবে দেশবাসীর? অন্যদিকে দেখুন, আত্মমগ্ন সরকারি দলের ডিমের খোলস ভাঙতে না পেরে মাইক্রোফোন সামনে নিয়ে খালি নালিশ আর নালিশ। আরে বাবা আসো না রাস্তায়। গ্রেফতার? সে তো সব আমলেই থাকে। তাছাড়া যদি নেমে আসো সামাজিক কারণে, একসময় জনগণই পাশে এসে দাঁড়াবে। বিষয়টা সরকার বিরোধিতারও না। বিরোধিতা হবে সামাজিক দস্যু, খুনি, ধর্ষকদের বিরুদ্ধে। কই সেভাবে তো কেউ-ই আসে না। বাম দলগুলো একসময় অগ্রণী ভূমিকা পালন করতেন। এখন? আওয়ামী লীগ ও সরকারের উপরি বিরোধিতার পর তাদের কাউন্সিলে যেতে পেরে আহ্লাদে আটখানা। এমন রাজনীতিকে মানুষ টা টা জানাবে না তো কি চুমা দিয়ে ঘরে তুলবে?
মূলত, সমাজ ও সামাজিকতা নিয়ে মাথাব্যথা নেই কারও। কিছু বললেই অমুক দেশ, তমুক দেশের তুলনা করে বলা হবেÑ এখনো আমরা ভালো আছি। এ রকম হিসেব করলে একসময় আফ্রিকার জঙ্গল ছাড়া তুলনার আর কিছু থাকবে? কত নারী যে অপমানিত হচ্ছে প্রতিদিন। আমরা যেসব ধর্ষণ দেখছি, সেগুলো ধরা পড়েছে বা জানাজানি হয়েছে। এর বাইরে? যানবাহনে, ঘরে, অফিসে, কাজে কোথায় না ধর্ষিতা হচ্ছেন মেয়েরা? ফেসবুক বা খোলা মিডিয়ার প্রলোভনে আধুনিকতার অন্ধকার দরজা খোলার কারণে বসগিরির দায়ে কিছু প্রাপ্তির প্রলোভনে এমনকি বাধ্য হয়েও তাদের মেনে নিতে হচ্ছে ধর্ষণ প্রক্রিয়া। অচিরেই বন্ধ না হলে, সমাজের মেরুদ- স্ত্রু দিয়েও টাইট রাখা যাবে না।
বলি, আগে নিজেকে সামলান। সবাই যার যার ঘরের দিকে নজর দিন। বাড়িতে সময় কাটান। যন্ত্র, মিডিয়া, মোবাইলের বাইরে আমাদের যে সামাজিক, পারিবারিক জগৎ ছিল তার দিকে ফিরে তাকান। প্রতিরোধ গড়ুন। রাজনীতি সঙ্গ না দিলে তাকে উপযুক্ত জবাব দিন। আজ মুখ বন্ধ করে ভালো আছেন, কাল থাকবেন তো?
নষ্ট সমাজ চরিত্রহীন মানুষের জগত কোনোদিন এগোতে দেবে না। আমরা শিশু থেকে বৃদ্ধা সব যৌন অনাচার, ধর্ষণ ও নারকীয়তার বিচার চাই। কিন্তু কার কাছে? যারা আগামী ভোটের জন্য দল গোছাতে ব্যস্ত তাদের কাছে? না যারা যেনতেন প্রকারে সরকারে আসতে সব ছাড় দিতে একপায়ে খাড়া তাদের কাছে? জবাবটা কিন্তু মানুষের ভিতরেই আছে। শুধু রুখে দাঁড়াচ্ছে না। আমরা কি তবে বোবা কালা জাতিতে রূপান্তরিত হয়ে গেছি?
লেখক: সিডনি প্রবাসী, কলামিস্ট ও বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষক
সম্পাদনা: আশিক রহমান