পশুপতিনাথ মন্দির
মন্দির পরিচিতি
ডেস্ক রিপোর্ট: হিন্দুদের মহাপবিত্র এবং পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন বিখ্যাত শৈব মন্দির হলো নেপালের পশুপতিনাথ মন্দির। এটি নেপালের সর্বশ্রেষ্ঠ অতি প্রাচীন জাগ্রত তীর্থক্ষেত্র। নেপালের রাজধানী কাঠমুন্ডুর পূর্বদিকে বাগমতি নদীর তীরে পশুপতিনাথ মন্দির অবস্থিত। হিন্দু ধর্মালম্বীদের কাছে এই মন্দিরটির গুরত্ব বহু প্রাচীনকাল থেকেই। দেবাদিদেব মহাদেব শিব তার অন্য নাম হলো পশুপতিনাথ। সেই নামেই এই মন্দিরটির নাম পশুনাথ মন্দির।
মন্দির সম্পর্কে বহু প্রাচীন পৌরাণিক কাহিনী রয়েছেÑ একবার শিব ও পার্বতী হিমালয়ের কোলে অবস্থিত নেপালের বাগমতী নদীর তীরে ভ্রমণ করতে এসেছিলেন, যেটা মৃগস্থলি নামে পরিচিত। নদী তীরবর্তী উপত্যাকায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে হরিণের বেশ ধরে ওই এলাকায় ঘুরে বেড়াতে থাকেন দুজনে। এখানে ভগবান শংকর মৃগরূপ ধারন করেন। এ বিষয়ে নেপাল মাহাত্মে বলা হয়েছেÑ ‘স্থিতো হং শুরূপেন শ্লেষ্মান্তকবনে যতঃ। অতঃ পশুপতির্লোকে মম নাম ভবিষ্যতি।
অনুবাদ: এই শেষ্মান্তক বনক্ষেত্রে আমি ঈশ্বর মৃগরূপ ধারন করে বিচরণ করেছি। যেহেতু ভবিষ্যতে এই ক্ষেত্র পশুপতি নামে বিশ্বসংসারে পরিচিত হবে।
তারপর থেকেই এখানে শিবকে পশুপতিনাথ হিসেবে পূজা করা হয়ে আসছে। ১৭৯৯ সালে নেপালের ধর্মপ্রাণ রাজা গিরভানাযুধ শাহ এই মৃগস্থিলির অনেক উন্নতি সাধন করেন। শিবপুরাণে আমরা কিরাতবেশি শিবের কথা পাই। পশুরূপ ধারণ করে তিনি অনেক লীলা করেছেন। এখানে আরেকটি বিষয় গবেষকগণ বলেন, মহাভারতে বনপর্বে অর্জুন মহাগরি হিমাচলের পরে দুর্গম অরণ্যে যান পশুপাত অস্ত্রের জন্যে। তবে এটাই কি সেই পশুপতিক্ষেত্র। আরও ব্যাপারটি জোরাল হয় যখন মহাভারত বলেÑ অর্জুনের তপ প্রভাবে শিব নিজেকে আর স্থির রাখতে পারলেন না। সর্বপাপন্তক ভগবান পশুপতি কিরাত বেশে…। তাহলে মহাভারতে আমরা দেবাদিদেবের পশুপতি নামটি পেলাম। এছাড়া ২য় পা-ব ভীমসেনও নেপালে এসেছিলেন।
এই মন্দির কবে প্রতিষ্ঠা হয়েছে, সে সম্পর্কে কোনো সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। নেপালের প্যাগোডা রীতিতে তৈরি এই পশুপতিনাথ মন্দিরটি চারকোণা। কাঠের কারুকার্য, কৌণিক গঠন সমস্ত কিছুই নেপালের ঐতিহ্য ও স্থাপত্যের অন্যতম অংশ। মন্দিরটির সারা গায়ে সোনা ও রূপার কারুকাজ রয়েছে। হিন্দু দেবদেবীদের মূর্তি খোদাই করা আছে মন্দিরের দেওয়ালে সর্বত্র। দুস্তর বিশিষ্ট ছাদ তামার তৈরি । তার উপর সোনার প্রলেপ দেওয়া আছে। মন্দিরটির প্রধান দরজা চারটি। প্রতিটি দরজাই রূপা দিয়ে মোড়া।
প্রত্যেকটি দরজার পাশে সোনা দিয়ে বিভিন্ন দেবতাদের মূর্তি খোদাই করা আছে। মূল মন্দিরে কালো পাথরের তৈরি শিবলিঙ্গ। জগৎ গুরু শিবাবতার হিন্দুর প্রাণ পুরুষ আচার্য শঙ্কর নেপালে হিন্দু ধর্মের ক্ষয়িষ্ণু অবস্থার কথা জানতে পেরে সেখানে যান। নব্য বৌদ্ধ প্রভাবে তখন নাকি পশুপতিনাথের পূজো পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। নেপালে তখন ঠাকুরী বংশের রাজা শিবদেব সিংহাসনে। তিনিও বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছেন মন্দিরের দিকে তাই দৃষ্টিহীন। হিন্দু প্রজাগণ হতাশায় আচ্ছন্ন। এই ক্রান্তিকালে স্বশিষ্য শিবাবতার শংকর সেখানে যান। রাজা তাকে স্বাগত জানান। তিনি সরাসরি মন্দিরে গিয়ে ধ্যানমগ্ন হন। তার আবির্ভাবে আবার জেগে উঠে পশুপতিক্ষেত্র। এ সময় রাজা শিবদেব আচার্যের ধর্ম উপদেশ শুনে আকৃষ্ট হন, তিনি তার শিষ্য হলেন। তিনি রাজাকে মন্দিরের পূজা আর্চনার ব্যাপারে যতœবান হতে বলেন এবং আচার্য শংকর নিয়ম করলেন এই তীর্থে দক্ষিণ ভারতের ভট্ট উপাধিধারী উপযুক্ত ব্রাহ্মণেরা এই মন্দিরের পুরোহিত হবেন। তারপর রাজা এই মন্দিরের সার্বিক উন্নিতি করেন।
এখানে শংকর চার্যের মঠ আছে মন্দির প্রাঙ্গণে। ১৯০৫ সালে শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমীর দিন এই মঠের নতুন ভিত্তি স্থাপন করেন শ্রী স্বামী রামানন্দগিরি। পরে এখানে ১৯৭৪ সালে শৃঙ্গেরি মঠের প্রধান শংকরাচার্য এখানে এসে আরও কিছু সংস্কার করেন। পশুপতিনাথ মন্দিরের চূড়া সোনা দিয়ে মোড়া। পশ্চিমের এক দরজার সামনে একটি বিশাল ষাঁড়ের মূর্তি রাখা আছে। যার নাম নন্দী। মুর্তিটি ব্রোঞ্জের তৈরি। তাতে সোনার প্রলেপ দেওয়া আছে। মন্দিরের ছাদের নিচের দিকে হিন্দু দেবদেবীদের নানান মূর্তি রয়েছে। যেমনÑ শিব, পার্বতী, গণেশ, কার্তিক, যোগিনীদের মূর্তি। এছাড়া রামায়ণ, পুরাণের বিভিন্ন কাহিনী চিত্র এখানে খোদাই করা রয়েছে। মন্দিরে একশোটিরও বেশি শিবলিঙ্গ ও অন্যান্য হিন্দু দেবতাদের মূর্তি বসানো রয়েছে। নেপালের পশুপতিনাথ মন্দিরটির অপূর্ব শৈল্পিক কারুকাজ ও ঐতিহ্যের জন্যই বিভিন্ন দেশ-বিদেশ থেকে তীর্থযাত্রীরা ভিড় করেন। এই মন্দির শৈবক্ষেত্র হলেও বৈষ্ণব শাক্ত, গাণপত্য, রামায়েত তান্ত্রিক ও বৌদ্ধ সকলের কাছেই মহাপবিত্র তীর্থ। এখানে মহাশিবরাত্রী ছাড়াও প্রায় সকল হিন্দু ধর্মীয় অনুষ্ঠান উদ্যাপিত হয়।