যজ্ঞ সমাচার
বিনয় ভূষণ জয়ধর
যজ্ঞ সম্পর্কে বর্তমানে প্রায় বেশিরভাগ মানুষের ধারণা যে এটি একটি সেকেলে, আদিম মানুষদের অনুষ্ঠান, যেখানে আগুন জ্বালিয়ে পরিবেশের দূষণ ঘটিয়ে বারোটা বাজানো হয়। অন্যদিকে কিছু পৌরাণিক উপাখ্যান পড়ে অনেকের এমন ধারণা হয়েছে যে, এটি সম্পূর্ণই কুসংস্কার প্রসূত। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে যজ্ঞের মধ্যে যে গূঢ় রহস্য লুকিয়ে আছে তা বেশিরভাগেরই অজানা।
যজ্ঞ কি? যজ্ঞ হচ্ছে মহৎ উদ্দেশ্যে সাধিত শুভ কর্ম। যেখানে বলি দেওয়া নিজের দাম্ভিকতাকে, স্বার্থপরতাকে এবং পাশবিকতাকে। যজ্ঞের দর্শন আমাদের শেখায় সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠাকে এবং তুলে ধরে এমন জীবন ব্যবস্থাকে যেখানে মানবীয় গুণাবলিকে রক্ষা ও এর আদর্শ সমাজে প্রচারিত করা হয়। এ রকম কিছু যজ্ঞ হচ্ছে সেবা যজ্ঞÑ যেখানে সমাজ সেবাই সকলের ব্রত। জ্ঞান যজ্ঞÑ মানবসমাজে জ্ঞানের আলোকবর্তিকা প্রজ্বলনের ব্রত। প্রাণ যজ্ঞÑ যেখানে জীবের প্রাণ রক্ষাই আমাদের ব্রত। সত্যি করে বলতে আমরা জেনে না জেনে অনেক যজ্ঞই করছি মনের অগোচরে। আমরা সাধারণত যজ্ঞ বলতে বুঝি একটি কু-ে আগুন জ্বালিয়ে মন্ত্র পাঠ করে বিভিন্ন প্রকার দ্রব্য আহুতি দেওয়া। বৈদিক ধর্মে এমনি নিত্য আচরিত একটি যজ্ঞ হচ্ছে হবন বা অগ্নিহোত্র। অনেক বস্তুবাদীই প্রশ্ন করতে পারেন, অগ্নিহোত্র কি অর্থহীন আড়ম্বর নয়? মোটেও নয়, বরং এর মাঝে লুকিয়ে আছে বিজ্ঞানের অন্যতম বিস্ময়।
আমাদের এ জগতে শক্তির মধ্যে তাপ শক্তি ও শব্দ শক্তি অন্যতম। যজ্ঞে এই দুই শক্তিরই সম্মেলনে আমরা অর্জন করতে পারি শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক উপকারিতা। যজ্ঞে বিভিন্ন পদার্থের দহন ওই বস্তুর অন্তর্নিহিত সঞ্চিত শক্তির উন্মোচন ও পরিবেশে ছড়িয়ে দেওয়ার একটি উৎকৃষ্ট প্রক্রিয়া। অন্যদিকে যজ্ঞে উচ্চারিত মন্ত্রের কম্পাঙ্ক শক্তি বহন করে এক আধ্যাত্মিক প্রেরণা।
যজ্ঞে সমিধ হিসেবে যেসব দ্রব্য ব্যবহার করা হয় তার মধ্যে থাকে নানা সুগন্ধি পদার্থ, ওষধি বৃক্ষের কাঠ, পুষ্টিকর খাদ্য ইত্যাদি। আপনাদের মনে হতে পারে এসব দ্রব্য পোড়ানোর ফলে বিপুল পরিমাণ কার্বন ডাই অক্সাইড, বিষাক্ত কার্বন মনো অক্সাইড, সালফার ডাই অক্সাইড প্রভৃতি উৎপন্ন হতে পারে। কিন্তু আপনি যদি বৈদিক কল্প ও ব্রাহ্মণ গ্রন্থের বিধি মোতাবেক সঠিক অনুপাতে জ্বালানি, দাহ্য পদার্থ ব্যবহার করেন এবং যজ্ঞকু- যদি শাস্ত্রীয় রীতি অনুসারে তৈরি করেন তবে কোনো বিষাক্ত গ্যাসই উৎপন্ন হবে না। যে কার্বন ডাই অক্সাইড যজ্ঞকু-ে উৎপন্ন হবে তা যজ্ঞকু-ের প্রবল উত্তাপে বাষ্পের সঙ্গে ক্রিয়া করে ফরমালডিহাইড উৎপন্ন করবে যা যজ্ঞকু-ের চারপাশের পরিবেশ সুগন্ধে পূর্ণ করে তুলবে। আর এই গ্যাস কেবল সুগন্ধিই নয়, বায়ুতে থাকা বিভিন্ন কীটানু দমনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অর্থাৎ যজ্ঞের মাধ্যমে আপনি পাবেন দুর্গন্ধ মুক্ত স্বাস্থ্যকর এক পরিবেশ। আর যে অল্প পরিমাণ কার্বন ডাই অক্সাইড থেকে যাবে সেটি সালোকসংশ্লেষণ ক্রিয়ার মাধ্যমে প্রকৃতিতে বিলীন হয়ে যাবে। যা একই সঙ্গে বৃক্ষরাজির খাদ্য ও পরিবেশে মুক্ত অক্সিজেনের যোগান দেবে। তাই যজ্ঞ কেবল যজ্ঞকারীর নয়, বরং সমগ্র পরিবেশ ও প্রকৃতির জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ।
অনেকে বলতে পারেন, যজ্ঞে ব্যবহৃত কাঠের জন্য তো প্রচুর বৃক্ষ নিধন করতে হবে। আপনাদের জন্য বলছি বৈদিক ঋষিগণ কেবল মৃত বৃক্ষের কর্তনেরই নির্দেশ দিয়েছেন। আর সেই সঙ্গে মনু আদি মহর্ষিরা ব্যাপকভাবে বৃক্ষরোপনেরও নির্দেশ দিয়েছেন। তাই যজ্ঞের জন্য কোনো জীবিত বৃক্ষ কর্তনের প্রয়োজন নেই, বরং মৃত বা মৃতপ্রায় বৃক্ষের কাঠই যজ্ঞে সমিধারূপে ব্যবহৃত হবে। বর্তমান পরিবেশ দূষণ ও রোগ মহামারীর যুগে যজ্ঞের আয়োজন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।