কালীপূজার রহস্য
স্বামী স্থিরাত্মানন্দ
ঈশ্বরের অনন্ত নাম, অনন্ত ভাব। সাধকেরা আন্তরিকভাবে যেকোনো নামে ও যেকোনোভাবে তাকে আরাধনা করলে তিনি কৃপা করেন। সকল ধর্মেই মহাপুরুষগণ এ কথা বলে গেছেন। কালীপূজা মাতৃভাবে ঈশ্বরের আরাধনারই এক রূপ। তিনি পুরুষও নন, নারীও নন। তাকে যে পুরুষ বলা হয় এর অর্থ সকলের অন্তরে বা পুরে তিনি সত্তারূপে বিরাজ করেন। তাকে মা বলা হয় সৃষ্টি, স্থিতি, বিনাশের সাপেক্ষে।
কিন্তু কালীপূজার প্রচলিত যে সকল ধারণা মানবসমাজে রয়েছে, তার সঙ্গে প্রকৃত তত্ত্বের পার্থক্য অনেক ক্ষেত্রে আকাশ পাতাল। শুদ্ধ অন্তকরণের সাধক যে দৃষ্টিতে তার সাধনার বিষয়গুলো উপলব্ধি করেন এবং কার্যে পরিণত করেন, সেগুলোই বিবেচনায় আনতে হবে। বিকৃত ধারণা কখনো সত্য উপলব্ধিতে সহায়তা করে না।
কালীর রূপ কালো কেন। অনেক দূরের জিনিস দেখা যায় না বা কালো বলে দেখা যায়। পৃথিবীর বায়ুম-লের ধুলিকণা সূর্যের আলোতে আলোকিত হয়ে নীল দেখা যায়। কিন্তু মহাকাশ পীচের মতো কালো। অনন্ত আকাশ নীল, অগাধ সমুদ্র নীল। সমুদ্রের জল দূর থেকে দেখলে নীল দেখায়, কাছে গিয়ে হাতে করে দেখলে, কোনো রঙই নেই। কাছের আকাশে কোনো রঙই নেই। দূরের আকাশ নীল। কালীর রঙ তাই কালো বা নীল। তাকে জানতে পারলে কোনো রঙই নেই। তিনি নির্গুণা, নিরাকারা। শুদ্ধ চৈতন্যময়ী। তিনিই আবার ত্রিগুণময়ী…সৌম্য সত্ত্বগুণ, কর্মশীল রজোগুণ আর মোহরূপ তমোগুণ। এ তিন গুণ তিনিই।
মহাকালীর আরাধনায় কি লাভ হয়, তা এ শ্লোকে বলা হয়েছে, দেবি প্রসীদ পরিপালয় নোহরিভীতেঃ নিত্যং যথাসুরবধাদধুনৈব সদ্যঃ।/ পাপানি সর্বজগতাঞ্চ শমং নয়াশু উৎপাতপাকজনিতাংশ্চ মহোপসর্গান্॥ (চ-ী-১১/৩৪) অর্থাৎ, ‘দেবী, আমাদের প্রতি আপনি প্রসন্না হোন। বর্তমানে যেমন ভবিষ্যতেও আপনি শত্রুভয় দূর করবেন। আপনি কৃপা করে জগতের সমস্ত পাপ এবং অধর্মের ফলে উৎপন্ন দুর্ভিক্ষ, মহামারী নাশ করুন।’ দেবী আবার স্বর্গসুখও মুক্তি উভয়ই দিতে পারেন (স্বর্গাপবর্গদে দেবী- চ-ী-১১/৮)। কালী প্রতিমায় দর্শনের চরম উপলব্ধিগুলো রূপ দেওয়া হয়েছে প্রতীকরূপে। অন্তর অশুদ্ধ হলে এগুলো বোঝা যায় না। পাপ চিন্তাই আমাদের অন্তরকে কলুষিত করে। এরপরেই আমরা অন্যের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হই। শ্রীসারদা দেবী বলছেন, ‘মানুষ আগে নিজের মনটি দোষী করে পরে অন্যের দোষ দেখে।’ আমাদের অন্তরকে শুদ্ধ করাই সকল সাধনার লক্ষ্য।
সন্তানকে মা যেমন বুকের দুধ দিয়ে পুষ্ট করে তোলেন, তেমনই তার আশ্রয় গ্রহণ করলে তিনি সাধককে ব্রহ্মজ্ঞানরূপ অমৃত বা পীযূষ দানে কৃতার্থ করেন। মায়ের দুগ্ধপূর্ণ স্তন দিয়ে তা বোঝানো হয়েছে। আবার অন্নরূপে তিনি ত্রিজগৎকে রক্ষা করেন। দুগ্ধপূর্ণ মায়ের স্তন এটাও প্রকাশ করেছে। তিনি ত্রিলোকের পাপবিনাশিনী। মাথা হচ্ছে সকল উপলব্ধির কেন্দ্র। বর্ণগুলোও শব্দরূপে গঠিত হয়ে প্রত্যেক ব্যক্তি বা বস্তুর নাম হয় এবং আমাদের বোধ উৎপাদন করে। শব্দই অর্থরূপে প্রকাশিত হয়ে জ্ঞান দান করে। সমস্ত শব্দের কারণ বর্ণমালা, আর বর্ণমালার প্রতীক মু-মালা। কালী তাই শব্দব্রহ্মরূপিণী। তিনি জননী। চরাচর জগতের অর্থাৎ চেতন ও জড় জগতের সৃষ্টিকারিণী। তিনি জীবের ভাগ্যও নির্ধারণ করেন কর্ম অনুসারে।
হাত হচ্ছে কর্মের প্রতীক। সৃষ্টির পর স্থিতি এবং পরে মহাপ্রলয়ে সমস্ত জীব কর্মফলসহ ঈশ্বরেই অবস্থান করে। নতুন কল্প বা সৃষ্টির পরিকল্পনা শুরু হলে আবার জীব কর্মফলসহ জন্মগ্রহণ করে, মানে নতুন শরীর পায়। ততকাল জীব তার কর্মফলসহ ঈশ্বরেই বিরাজ করে। এটা দেখানোর জন্য মায়ের কোমরে মৃতের হাত দিয়ে অলঙ্কার তৈরি হয়েছে। মায়ের গর্ভ থেকে যেমন শিশুর জন্ম হয়, তেমনই বিশ্বজননী বা ঈশ্বর থেকেই সমস্ত জগৎ বা ব্রহ্মা-ের উৎপত্তি। কবির সূক্ষ্ম উপমায় ঈশ্বর থেকেই সৃষ্টি, ঈশ্বরেই স্থিতি এবং ঈশ্বরেই লয়Ñ এই সত্যই কালী প্রতিমায় দেখানো হয়েছে।
পরম ঈশ্বর সমস্ত মায়ার অতীত। সমস্ত আবরণের অতীত। কাপড় বা বসন যেমন আবরণ, তেমনই মায়ার আবরণই ঈশ্বরের আবরণ। মায়াই আমাদের দৃষ্টিকে আবৃত করে রেখেছে। কিন্তু ঈশ্বর মায়ার অধীশ্বর, মায়া তাকে আবৃত করতে পারে না, ঢাকতে পারে না। এই সত্যকেই প্রকাশ করা হয়েছে মা কালী দিগ্বসনাÑ তার গায়ে কোনো বসন নেই এই প্রতীকে। মহাপ্রলয়ে ঈশ্বরের সত্তাতেই সবকিছু বিলীন হয়। এ ভাবটি দেখানোর জন্যে তাকে শ্মশ্মানে দেখানো হয়েছে। শ্মশ্মানে জীবের দেহ ধ্বংস হয়ে লয় পায়। প্রজ্বলিত শ্মশ্মান বহ্নিমধ্যে মানে জ্বলন্ত চিতার আগুনের মধ্যে অর্থাৎ সূর্য ও চন্দ্রের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত দিন, মাস, বছর প্রভৃতি কালের মধ্যে তিনি আনন্দে নিমগ্না। মানে কালরূপ অগ্নির মধ্যে বা মহাকালের মধ্যে পরিবর্তনগুলো নিয়ে খেলা করছেন, আনন্দ করছেন। মহাদেবের বুকে তিনি সৃষ্টি স্থিতি প্রলয় করছেন, মানে আদি-অন্তহীন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঈশ্বরের সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় লীলা চলছে। যা আনন্দিত করে তাই মদ্য। ব্রহ্মানন্দই পরম আনন্দ। দেবী ব্রহ্মানন্দেই প্রতিষ্ঠিতা, এজন্য বলা হয় তিনি মদমত্ত।
কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য এই ষড় রিপু বা ছয়টি শত্রু থেকে মুক্ত হবার জন্য এগুলো মায়ের চরণে বলি অর্থাৎ উপহার দিতে হয়। কামের প্রতীক ছাগল, ক্রোধের প্রতীক মহিষ, লোভের প্রতীক মানুষ, মোহের প্রতীক ভেড়া, মদের প্রতীক উট এবং মাৎসর্যের বা পরশ্রীকাতরতার প্রতীক হলো বিড়াল বা মার্জার। এজন্য প্রতীকী ভাষায় বলা হয় ছাগ, মহিষ, নর, মেষ, উষ্ট ও মার্জার মায়ের পূজায় বলি দিতে হয়।
শুধু তাই নয় এগুলোর অস্থি ও লোমসহ মাংস নিবেদন করতে হয়। এর মানে লোভ-লালসার মানসিক চিন্তাসহ মায়ের চরণে নিবেদন করতে হয়। এর ফলে সাধক এ সব রিপু বা শত্রু থেকে মুক্ত হয়ে শুদ্ধ অন্তরে ঈশ্বরীয় আনন্দ অনুভব করে ধন্য হতে পারে। সাধক কবিও গেয়েছেন, ‘আমার অহঙ্কারকে বলি দিতে কালীপূজার আয়োজন। অথবা, ভুল করেছি ও মা শ্যামা বনের পশু বলি দিয়ে।/তুই যে বলিদান চেয়েছিস কাম ছাগ ক্রোধরূপী মহিষ।’
রহস্য জেনে নিয়ে মা কালীর পূজায় অহঙ্কারশূন্য হয়ে আমাদের সকলের অন্তর শুদ্ধ হোকÑ এ প্রার্থনা পরমেশ্বরের কাছে।
লেখক: সহাধ্যক্ষ, রামকৃষ্ণ মঠ, ঢাকা