বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ লুট মানিলন্ডারিং ও চুরিতে জড়িতরা শনাক্ত হলেও হ্যাকাররা অশনাক্ত
*২৩ জনের তালিকা তৈরি *চতুর্থ বৈঠক নভেম্বরে ঢাকায় *চলতি বছর শেষ হচ্ছে না তদন্ত
সুজন কৈরী: বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ লুটের ঘটনায় মানিলন্ডারিং ও চুরির সঙ্গে জড়িতরা চিহ্নিত হলেও হেকিংয়ের সঙ্গে জড়িতরা এখনও শনাক্ত হয়নি। এ ঘটনায় জড়িত ২৩ জনের একটি তালিকা তৈরি করেছে সিআইডি। তালিকাটি গত ৪ থেকে ৬ অক্টোবর সিঙ্গাপুরের ইন্টারপোল সদর দফতরে একটি কো-অর্ডিনেশন বৈঠকে দেওয়া হয়েছে।
মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা এবং সিআইডির অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক মো. শাহ আলম বলেন, ইন্টারপোলের সিঙ্গাপুরের সদর দফতরের বৈঠকে বাংলাদেশ, ফিলিপাইন ও চীনসহ ৬টি দেশ সরসরি অংশ গ্রহণ করে। এছাড়া শ্রীলঙ্কাসহ দুটি দেশ বৈঠকে টেলিকনফারেন্সের মাধ্যমে অংশ নেয়। এছাড়া ওয়ার্ল্ড ব্যাংকও এই বৈঠকে ছিল। আটটি দেশের মোট ২৫ জন প্রতিনিধি বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। শ্রীলঙ্কাসহ দুটি দেশের ৬/৭জন টেলিকনফারেন্সের মাধ্যমে বৈঠকে অংশ নেয়। এফেক্টিভ দেশগুলোর সঙ্গে ঘটনা তদন্তের বিষয়ে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। প্রাইমারী লেভেলে ঘটনার তদন্তে অনেকটাই অগ্রগতি হয়েছে। যেমন শ্রীলঙ্কা ও ফিলিপাইনে মানিলন্ডারিং ও চুরির বিষয়ে যারা ফিল্ড অপারেটিভ তাদের শনাক্ত করা হয়েছে। দুদেশের ব্যাংক কর্তৃপক্ষের কয়েকজনও এ টাকা লোপাটের সঙ্গে জড়িত। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংক স্টপ পেমেন্টের (টাকা প্রদান না করা) অনুরোধ করলেও আরসিবিসি কর্তৃপক্ষ প্রথমে পেমেন্ট স্থগিত করে। সিআইডি কর্মকর্তা বলেন, সেকেন্ডারি লেভেলে আমাদের আরও বেশকিছু তথ্য-উপাত্ত প্রয়োজন রয়েছে। বিশেষ করে ফিল্ড অপারেটিভ যারা আছে; তাদের পেছনে থাকা ব্যক্তিদের শনাক্ত করতে আরও তথ্য-উপাত্ত প্রয়োজন। বৈঠকে ওয়ান টু ওয়ান ও গ্রুপ ডিসকাশনও হয়েছে। এ বিষয়ে সবার সহযোগিতা চেয়েছি। কেউ কেউ সহযোগিতার আশ্বাসও দিয়েছেন। বৈঠকে আমরা রিজার্ভ চুরির ঘটনায় ২৩ জনের তালিকা দিয়েছি। ওই তালিকায় ফিলিপাইনের বাইরের লোকজনও রয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, বিশেষ করে এফেক্টিভ কান্ট্রির আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে এ ঘটনায় যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল কেস করার জন্য তাগিদ দিয়েছি। শুধু মানি লন্ডারিং ও চুরি নয়, তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই কারা হেকিংয়ে জড়িত তা বের হয়ে আসবে। ফিলিপাইনের আরসিবিসি ব্যাংকের স্থানীয় ব্যবস্থাপক মায়া দিগুইতো এ ঘটনায় জড়িত। ব্যাংক কর্তৃপক্ষের উচ্চপদস্থ অনেকেই জড়িত। মায়া দিগুইত তার ব্যাংকে যে ৪টি ভুয়া একাউন্টের মাধ্যমে টাকা ছাড় করেন, তার মধ্যে দু’টি একাউন্ট খোলা হয়েছে দিগুইতর এক বন্ধুর ছবি ও ওই ব্যাংকের এক কর্মকর্তার ছবি দিয়ে। এছাড়া স্টপ পেমেন্টের পরও টাকা ছাড় করার বিষয়ে ওই ব্যাংকের উচ্চপদস্থ অনেকেই যে জড়িত তার প্রমাণ আমাদের কাছে রয়েছে। টাকা ছাড় করার আগে ব্যবস্থাপক মায়া ও ব্যাংক কর্তৃপক্ষের কথা-বার্তার প্রমাণ আমাদের কাছে রয়েছে। মায়া দিগুইত’র ব্রাঞ্চে প্রতিদিন ৫ মিলিয়ন পেসোর মত লেন-দেন হয়। কিন্তু একদিনে ৪২ দশমিক ৯ মিলিয়ন ডলার কিভাবে পেমেন্ট করলেন এমন প্রশ্নের কোনো সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারেনি ব্যবস্থাপক মায়া। তবে অন্য এক সূত্র নিশ্চিত করে যে, বিশেষ ব্যবস্থায় গাড়ি ভর্তি টাকা এনে পেমেন্ট দেখানো হয়। ফিলিপাইন সংসদের একটি কমিটিতে শুনানির পর আরসিবিসি ব্যাংক কর্তৃপক্ষের হাত রয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। এছাড়া ফিলিপাইন সেন্ট্রাল ব্যাংক আরসিবিসি ব্যাংককে ১ মিলিয়ন পেসো জরিমানা করেছে। এতে প্রমাণ হয় আরসিবিসি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এ ঘটনায় জড়িত। এখনো কেউই মামলা করেনি। আনুষ্ঠানিকভাবেই তাদেরকে মামলা করার তাগিদ দেয়া হয়েছে।
চলতি বছর শেষ হচ্ছে না তদন্ত: চলতি বছর রিজার্ভ চুরির ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার তদন্ত শেষ হচ্ছে না। রিজার্ভ চুরির ঘটনার তদন্তের বিষয়ে সিআইডির ফরেনসিক ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের কমান্ডেন্ট ও মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা মো. শাহ আলম বলেন, আমাদের তদন্ত এগুচ্ছে। অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। এ ঘটনার সঙ্গে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পক্ষ জড়িত। তিনি আরও বলেন, তদন্তটা যদি আজকেও শেষ করা যেত, তারপরও আরও কয়েক মাস সময় লাগবে চার্জশিট দিতে। কারণ, তদন্তের বিভিন্ন পর্যায়ে পাওয়া তথ্য-প্রমাণগুলো নিশ্চিত করতেও কয়েক মাস সময় লাগবে।
প্রসঙ্গত, চলতি বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্রে পরিচালিত বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ লেনদেনকারী হিসাব থেকে ৭০টি ভুয়া পেমেন্ট ইনস্ট্রাকশনের (পিআই) মাধ্যমে ১৯২ কোটি ৬০ লাখ ডলার অবৈধভাবে স্থানান্তরের চেষ্টা করে আন্তর্জাতিক জালিয়াত চক্র। এরমধ্যে ৪টি পিআই’র বিপরীতে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার ফিলিপাইনের একটি ব্যাংকের চারজন গ্রাহকের হিসাবে পাঠানো হয়। সম্পাদনা: আজাদ হোসেন সুমন