ভ্রাতৃত্ব বোধ ও ধর্মীয় সম্প্রীতি
“দেখ, ইহা কেমন উত্তম ও কেমন মনোহর যে, ভ্রাতারা একসঙ্গে ঐক্যে বাস করে ”। গীতসংহিতা ১৩৩ : ০১ পদ
রেভা. সুধীর হালদার
প্রিন্সিপাল, সি.ডি.সি,
বোর্ড বাজার, গাজীপুর
বাইবেল পাঠ : লূক ১০: ২৫-৩৭ পদ
“ আর দেখ, এক জন ব্যবস্থাবেত্তা উঠে তাঁর পরীক্ষা করে বললো, হে গুরু, কি করলে আমি অনন্ত জীবনের অধিকারী হব? তিনি তাকে বললেন, ব্যবস্থায় কি লেখা আছে? কি পাঠ করেছো? সে উত্তর করে বললো,” তুমি তোমার সমস্ত অন্তঃকরন, তোমার সমস্ত প্রান, তোমার সমস্ত শক্তি ও তোমার সমস্ত মন দিয়ে তোমার ঈশ্বর প্রভুকে প্রেম করবে, এবং তোমার প্রতিবাসীকে আপনার মত প্রেম করবে ”।
তিনি তাকে বললেন, ঠিক উত্তর বলেছো; তাই কর, তাহলে জীবন পাবে। কিন্তু সে তাকে নির্দ্দোষ দেখাবার জন্য যীশুকে বললো, ভাল, আমার প্রতিবাসী কে? এই কথা শুনে যীশু বললেন, এক ব্যক্তি যিরুশালেম হতে যিরীহোতে নামিয়া যাচ্ছিল, এমন সময়ে দশ্যুদলের হাতে পড়ল; তারা তার কাপড় খুলে নিল, এবং তাকে মারধর করে আধমরা করে ফেলে চলে গেল। ঘটনাক্রমে একজন পুরোহিত সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিল; সে তাকে দেখে এক পাশ দিয়ে চলে গেল। পরে ঠিক একিই ভাবে একজন লেবীয় সেই স্থানে এসে দেখে এক পাশ দিয়ে চলে গেল। কিন্তু একজন শমরীয় সেই পথ দিয়ে যেতে যেতে তার কাছে আসলো; পরে তাকে দেখে মনে কষ্ট হল, তার কছে এসে তেল ও দ্রাক্ষারস ঢেলে দিয়ে তার সব ক্ষতস্থান বেধে দিল। পরে নিজের গাধার পিঠে তাকে বসিয়ে তাকে সেবা কেন্দ্রে নিয়ে গেলেন এবং তার যতœ করলেন। পরের দিন দুইটি মুদ্রা বের করে সেবা কেন্দ্রের মালিককে দিয়ে বললেন, এই লোকের প্রতি যতœ নিবেন, যদি এর বেশি মুদ্রা খরচ হয়, আমি যখন ফিরে আসব, তখন পরিশোধ করব।
এই তিন জনের মধ্যে কে ঐ দশ্যূদের হাতে পরা লোকের প্রতিবাসী হলো? সে বললো, যে লোক তার প্রতি দয়া করলো, সেই। তখন যীশু তাকে বললেন, যাও, তুমিও সেই ভাবে কর। যীশু যখন এই পৃথিবীতে ছিলেন, তখন একজন যিহূদী ধর্মগুরু যীশুর কাছে এসে যীশুকে পরীক্ষা করার জন্য বললেন, কি ভাবে বা কি করে একজন লোক পরিত্রান পেতে পারে অথবা স্বর্গবাসী হতে পারে? যীশু এ প্রশ্নের উত্তর সেই যিহূদী ধর্মগুরুর কাছেই জানতে চাইলেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন পুরাতন নিয়মে পরিত্রান সম্পর্কে কি লেখা আছে? এবারে যীশুর প্রশ্নের উত্তরে ঐ যিহূদী ধর্মগুরু বললেন, পুরাতন নিয়মের সবচেয়ে প্রধান আজ্ঞাটি। এই আজ্ঞাতে দুইটি অংশ রয়েছে। প্রথমটি সমস্ত মন, প্রাণ ও শক্তি দিয়ে ঈশ্বরকে ভালবাসা এবং দ্বিতীয়টি, একই ভাবে প্রতিবাসীকে ভালবাসা। এই দুইটি কাজ করতে পারলে একজন লোককে ধার্মিক বলা হতো। যদি কোন লোক ঈশ্বরের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক স্থাপন করেছে কিন্তু প্রতিবাসীর সঙ্গে ভাল সম্পর্ক স্থাপন করতে বা ভালবাসতে না পারে, তবে সেই ব্যক্তি ধার্মিক বলে মান্য হতো না। আবার, যদি কোন লোক প্রতিবাসীর সঙ্গে ভাল সম্পর্ক বা ভালবাসা স্থাপন করেছে কিন্তু ঈশ্বরের সঙ্গে ভালবাসার সম্পর্ক স্থাপন করতে না পারে, তবে সে ব্যক্তিও ধার্মিক বলে মান্য করা হতো না। ঐ যিহূদী ধর্মগুরু যীশুর কাছে দ্বিতীয় প্রশ্ন করলেন, “আমার প্রতিবাসী কে?” তখন যীশু এই প্রশ্নের উত্তর এই দৃষ্টান্তের মাধ্যমে দিলেন। যীশুর বলা এই দৃষ্টান্তের মধ্যে বাইবেলের পুরাতন নিয়মের শিক্ষার মধ্যে যে গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে, তা হলো “ভ্রাতৃত্ব বোধ বা অন্যের প্রতি ভালবাসা এবং সাহায্য প্রদান করা। এই দৃষ্টান্তে, আমরা চার শ্রেনীর লোকের চরিত্র বা বৈশিষ্ট দেখতে পাই। দশ্যূদের হাতে পরা ব্যক্তি চার শ্রেনীর লোকের সাক্ষাত পেয়েছিল। তার মধ্যে প্রথম শ্রেনী হচ্ছে দশ্যূ বা ডাকাত। দশ্যূ বা ডাকাতের ধর্ম বা নীতি হচ্ছে, ‘যা কিছু তোমার তা আমার, যে কোন ভাবে তা আমি তোমার কাছ থেকে নিয়ে নেব’। সে কাজটি অস্ত্রের বা বল প্রয়োগের মাধ্যমেও হতে পারে।
দ্বিতীয় লোকটি ছিলেন একজন যাজক বা পুরোহিত। তিনি দশ্যূদের হাতে আহত লোকটিকে দেখে পাশ দিয়ে চলে গেলেন। তার ধর্ম বা নীতি হচ্ছে, ‘যা আমরা তা শুধু আমার নিজের জন্যই ব্যবহার করবো,অন্যের সাহায্যে জন্য নয়’। আমার ধার্মিকতা, উত্তমতা, অর্থ ও শ্রম আমার নিজের জন্য, অপরের জন্য নয়। তৃতীয় ব্যক্তি ছিলেন একজন লেবীয়, যার কাজ ছিল যাজকদের ধর্মীয় কাজে সাহায্য করা। তিনি ও যাজকের ধর্ম ও নীতি পালন করলেন। দশ্যূদের হাতে আহত লোকটির পাশ দিয়ে চলে গেলেন, কিন্তু কোন সাহায্য করলেন না। চতুর্থ ব্যক্তি ছিলেন একজন শমরীয়। সেই সময়ে শমরীয় জাতির লোকদের খুব নীচু দৃষ্টিতে দেখা হতো। অন্য কোন জাতির লোকদের সঙ্গে তারা চলতে পারতো না বা উঠা বসা ছিল না।
শমরীয় লোকটি যখন পথের পাশে ঐ লোকটিকে দেখতে পেলেন, তখন তিনি এগিয়ে গিয়ে তার সেবা যতœ করে, তার গাধার পিঠে তুলে একটি সেবা কেন্দ্রে নিয়ে গেলেন। তার চিকিৎসার জন্যে দুইটি মুদ্রা দিলেন এবং সেবা কেন্দ্রের মালিককে অনুরোধ করলেন তার চিকিৎসার বাকী অর্থও তিনি পরিশোধ করবেন। শমরীয় লোকটি ধর্ম ও নীতি ছিল, “যা কিছু আমার তা তোমার, তোমার সেবা ও সাহায্যের জন্যে আমি তা ব্যয় করবো”। আহত লোকটির জন্য শমরীয় তার তেল, দ্রক্ষারস, গাধা, অর্থ এবং শ্রম দিয়ে সাহায্য করে লোকটির প্রাণ রক্ষা করে ছিলেন।
বাইবেলের এই দৃষ্টান্তের কথা পড়তে পড়তে, আমরা কি আমাদের নিজেকে “আতেœা-জিজ্ঞাসা করতে পারি, আপনি ও আমি কোন ধর্ম বা নীতি অবলম্বন করে চলছি?”
বাইবেলের পুরাতন নিয়ম এবং নূতন নিয়ম একাই ভাবে বলেছে- প্রথমে ঈশ্বরকে মন, প্রাণ ও সমস্ত শক্তি দিয়ে তাঁকে ভালবাসতে হবে ঠিক একই মত প্রতিবাসীকে ভালবাসতে হবে। আর তখনই আমরা অনন্ত জীবনের অধিকারী হবো। মথি ২৫ : ৩৫ – ৪০ পদে প্রভু যীশু একই কথা বলেছেন, “এই ক্ষুদ্রতমদিগের মধ্যে এক জনের প্রতি যখন ইহা করিয়াছিলে, তখন আমারই প্রতি করিয়াছিলে”।
আসুন, আমরা আমাদের জন্মভূমি বাংলাদেশ এবং আমাদের দেশের জনগনকে নৈতিক অবক্ষয় থেকে রক্ষা করি, একমাত্র ধর্মীয় শিক্ষা ও চেতনার মাধ্যমে এটি সম্ভব। মনে রাখবেন – “যদি আপনার লোকজন ধর্মীয় কর্মকান্ড থেকে একবার মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে পরবর্তীতে তাদের ধর্মের দিকে ফিরিয়ে আনা খুবই কষ্টকর হবে”।
আতœ-শুদ্ধির জন্য, অন্য কোন শিক্ষা কাজে আসবে না। পিতামাতা ও সন্তান সন্তুতিদের ধর্মীয় শিক্ষায় উব্ধদ করুন। তা না হলে, দেশ ও দশের মঙ্গল হবে না। শিক্ষা দেন, অন্য ধর্ম ও ধর্মের লোকদের সন্মান করতে এবং ভালবাসতে। আমাদের বড় পরিচয় আমরা বাংলাদেশী এবং বাঙ্গালী। এই দেশের উন্নতি, অবনতি, সুনাম, দূরনাম আপনার ও আমার।
অনুলেখক : ম্যাকডোনাল্ড মিঠুন বৈরাগী