নারী ক্ষমতায়ন বাড়লেও কমছে না নির্যাতন
ড. বদরুল হাসান কচি
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ ‘ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট
উইমেন সার্ভে ২০১৫’ শীর্ষক দ্বিতীয় জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, দেশে বর্তমানে বিবাহিত নারীদের শতকরা ৮০ জনই কোনো না কোনোভাবে নির্যাতনের শিকার হন। আর সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হন স্বামীর হাতে। কিন্তু পারিবারিক সম্মানসহ বিভিন্ন বিষয় চিন্তা করে অধিকাংশ নারী নীরবে এ নির্যাতন সহ্য করেন।
একবিংশ শতাব্দীতে এসেও এখনো নারীর জন্য একটি নিরাপদ রাষ্ট্র হয়ে ওঠেনি। আমাদের অনেক প্রাপ্তির মধ্যে এটা বিশাল অপূর্ণতা। অথচ ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধসহ প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে রাজপথে আমাদের নারীদের সাহসী অংশগ্রহণের ছবি ও কাহিনী শুনে গর্ব হয়। আশ্চর্য হলোÑ সেদিনগুলোর কোনো ছবিতে কোনো নারীকে বোরকা পরাও দেখা যায় না, সবার পরণে চিরায়ত শাড়ি কিংবা সেলোয়ার। এখন নানান পন্থায় পর্দা মেনে চললেও নারীরা আজ রাস্তায় একাকি নির্ভয়ে পথ চলতে পারে না। স্বাধীন দেশের রাস্তাঘাটে, বাসে-ট্রেনে, কর্মক্ষেত্রে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সর্বত্রই আজ নারীরা নিপীড়নের শিকার। রক্ষা পাচ্ছে না ফেসবুকের মতো নানান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছর সারাদেশে উত্ত্যক্তের শিকার হয় ৩৬২ জন নারী ও শিশু। এর মধ্যে তাৎক্ষণিক প্রতিকার না পেয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে ২২ জন। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১০৯ জন নারী বখাটেদের উৎপাতের শিকার। আর ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৫১২টি। এসব পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে বাংলাদেশে নারীরা কতটা সংকটে। চুরি, ডাকাতি, খুন, অপহরণ যেকোনো অপরাধের চেয়ে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা অনেক বেশি ঘটে এ দেশে। অথচ আমরা প্রতিনিয়ত উদাহরণ টানছি, বাংলাদেশ নারী ক্ষমতায়নে রোল মডেল। বিশ্বপরিম-লেও আমাদের এই সাফল্যকে বেশ ইতিবাচকভাবে দেখছে; যার ফলে নানান সময় স্বীকৃতি দিয়ে আমাদের রাষ্ট্রপ্রধানকে প্রেরণা দিচ্ছেন। উদাহরণ দেখতে খুব পেছনে যেতে হয় না, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে যোগ দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারীর ক্ষমতায়নে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘এজেন্ট অব চেঞ্জ’ অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন এবং একই সঙ্গে তিনি ‘প্ল্যানেট ৫০-৫০ চ্যাম্পিয়ন’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন। আন্তর্জাতিক এই স্বীকৃতিগুলো কোনো গালগপ্পের মধ্য দিয়ে মিলছে না; আন্তর্জাতিক নানান পরিসংখ্যান ও সমীক্ষা দেখেই তবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। খুব সম্প্রতি এমন একটি সমীক্ষার উদাহরণ টানতে পারি, নারী-পুরুষের সমতার ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে আছে বাংলাদেশ। ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরামের প্রকাশিত বৈশ্বিক লিঙ্গ বিভাজন সূচক (গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ ইনডেক্স) প্রতিবেদন ২০১৬-তে বাংলাদেশের অবস্থান ৭২ নম্বরে, যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে।
সবই ঠিক আছে, কিন্তু ৫ বছরের পুজা যখন সাইফুলদের হাতে ধর্ষিত হয়ে ক্ষত-বিক্ষত হয় কিংবা কলেজপড়ুয়া খাদিজা প্রেম প্রত্যাখ্যান করায় যখন বখাটে বদরুলদের চাপাতির আঘাতে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয় তখন সকল অর্জন ম্লান হয়ে যায়। নারী ক্ষমতায়ন ও অগ্রগতি একদিকে যেমন প্রশংসনীয় অন্যদিকে দিনে দিনে নারী ও মেয়ে শিশুর প্রতি বর্বর নির্যাতনের মাত্রা বৃদ্ধি আমাদেরকে অসভ্য জাতি হিসেবে চিহ্নিত করে।
বাংলাদেশ একটি উন্নত দেশ হিসেবে বিশ্বের কাছে পরিচিত হতে চায়, সে লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার; আমরা আস্থা রাখতে চাই। কিন্তু উন্নয়ন বলতে কেবল অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলে হবে না, সামাজিক এই তীব্র সংকটগুলো কাটিয়ে ওঠাও জরুরি। এই ব্যাপারে সরকারের নজরদারি যাই থাকুক, সেটা আরও বৃদ্ধি করা জরুরি তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ লেখার শুরুতেই সরকারি একটি পরিসংখ্যানের কথা উল্লেখ করেছি, সে সংবাদটি কেবল আমাদের হতাশ করে না; ভীষণভাবে লজ্জিত ও মর্মাহত হতে হয়।
লেখক: সম্পাদক, ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম
সম্পাদনা: আশিক রহমান