রিটার্নিং অফিসার নিয়োগে আইন কী বলে?
ইকতেদার আহমেদ
লেখক: সাবেক জজ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিটি জেলার বিপরীতে একাধিক নির্বাচনি এলাকার জন্য একজন রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ দেওয়া হয়। নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ কার্যটি গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ এর অধীন সমাধা করে। রিটার্নিং অফিসারকে সহায়তা করার জন্য প্রতিটি নির্বাচনি এলাকার জন্য একজন সহকারি রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ দেওয়া হয়। বাংলাদেশ অভ্যুদ্বয় পরবর্তী এ যাবৎকাল পর্যন্ত জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রশাসন ক্যাডারের জেলার দায়িত্বে নিয়োজিত জেলা প্রশাসক পদধারী কর্মকর্তাদের রিটার্নিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়ে আসছে। সহকারী রিটার্নিং অফিসার হিসেবে ১৯৯০ খ্রি. পরবর্তী উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের নিয়োগ দেওয়া হয়ে আসছে, যদিও বিগত দশম সংসদ নির্বাচনে কতিপয় নির্বাচনি এলাকায় থানা নির্বাচন অফিসারদের সহকারী রিটার্নিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সংসদ বহাল থাকাকালীন অবস্থায় মৃত্যু বা অন্য যেকোনো কারণে সংসদ সদস্য পদ শূন্য হওয়ার ক্ষেত্রে এরূপ একাধিক নির্বাচনে জেলা নির্বাচন অফিসারদের রিটার্নিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার নজির রয়েছে। এ সকল নির্বাচনে থানা নির্বাচনি অফিসারদের সহকারী রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।
রিটার্নিং অফিসার প্রতিটি ভোট কেন্দ্রের জন্য সরকারি অথবা বেসরকারি সংস্থার একজন কর্মকর্তাকে প্রিজাইডিং অফিসার, এক বা একাধিক কর্মকর্তাকে সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার এবং প্রতিটি ভোট কক্ষের জন্য একাধিক পোলিং অফিসার নিয়োগ দিয়ে থাকেন। এ সকল কর্মকর্তা নিয়োগ বিষয়ে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে সরকারি অথবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিষয়টি উল্লেখ থাকলেও রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ বিষয়ে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে তারা সরকারি বা বেসরকারি হওয়া বিষয়টি অব্যক্ত।
জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান একটি বৃহৎ ও ব্যাপক কর্মযজ্ঞ। নির্বাচন কমিশনের সীমিত জনবল দিয়ে এ বৃহৎ ও ব্যাপক কর্মযজ্ঞ পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। আর তাই এ কারণেই নির্বাচন কমিশনকে সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে যে নির্বাচনি দায়িত্বপালন করতে গিয়ে নির্বাচন কমিশনের যেরূপ জনবলের প্রয়োজন হবে নির্বাচন কমিশন দ্বারা অনুরুদ্ধ হলে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশনকে সেরূপ জনবল প্রদানের ব্যবস্থা করবেন। এ বিষয়ে রাষ্ট্রপতির কোনো পৃথক নির্বাহী ক্ষমতা না থাকায় তিনি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী তার কার্য সমাধা করেন।
সংবিধানে নির্বাচন কমিশনকে একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন একজন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অনধিক পাঁচজন নির্বাচন কমিশনার সমন্বয়ে গঠিত। সাংবিধানিক পদধারী হিসেবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারগণ শপথের অধীন। শপথ গ্রহণ ব্যতিরেকে তারা স্বীয়কার্যে আসীন হন না। শপথগ্রহণ করা কালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনারদের অপরাপর বিষয়ের পাশাপাশি বলতে হয় তারা সংবিধানের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করবেন এবং তাদের সরকারি কার্য ও সরকারি সিদ্ধান্তকে ব্যক্তিগত স্বার্থের দ্বারা প্রভাবিত হতে দিবেন না।
দেশে ইতোপূর্বে দলীয় ও নির্দলীয় উভয় সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন রিটার্নিং অফিসার ও সহকারী রিটার্নিং অফিসার নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বীয় স্বাধীনতাকে পাশ কাটিয়ে সরকারের আকাক্সক্ষার প্রতিফলনে নিয়োগ কার্য সমাধায় সচেষ্ট থেকেছে। এ যাবৎকাল পর্যন্ত দলীয় ও নির্দলীয় সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদের প্রতিটি সাধারণ নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসার নিয়োগের ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসকের অন্যথা প্রত্যক্ষ করা যায়নি। জেলা প্রশাসকগণ জেলায় সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে দলীয় ও নির্দলীয় উভয় সরকারের আস্থাভাজন। যেকোনো দলীয় বা নির্দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে জেলা প্রশাসকের কাছে দলীয় বা নির্দলীয় সরকারের কোনো আকাক্সক্ষা থাকলে তা পরিপূরণে তারা যে নির্বাচন কমিশনের চেয়ে সরকারের আকাক্সক্ষাকে অধিক গুরুত্ব দিবেন তা ইতোপূর্বে অনুষ্ঠিত নির্বাচন সমূহের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ করা গেছে।
নির্বাচন কমিশন চাইলে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারের পরিবর্তে সরকারের অন্য যেকোনো বিভাগের কর্মকর্তাদের জাতীয় সংসদের নির্বাচনি দায়িত্ব পালনের জন্য রিটার্নিং অফিসার অথবা সহকারী রিটানির্ং অফিসার হিসেবে নিয়োগ দিতে পারেন। আবার কোনো একক বিভাগের পরিবর্তে বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তাদের সমন্বয়েও এ দায়িত্ব পালনে কোনো বাধা নেই। এ কথাটি অনস্বীকার্য যে, সশস্ত্র বাহিনীসহ সরকারের কয়েকটি বিভাগ হতে রিটার্নিং অফিসার ও সহকারী রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ দেওয়া হলে প্রতিটি বিভাগের মধ্যে একটি প্রতিযোগী ভাব কাজ করবে যেকোনো বিভাগ দায়িত্বটি সূচারুরূপে পালনে কতটুকু সফলতা দেখাতে পেরেছে। এ ধরনের প্রতিযোগী ভাব সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যে সহায়ক তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানকালীন প্রতিটি জেলার অন্তর্ভুক্ত নির্বাচনি এলাকার নির্বাচন সংক্রান্ত যাবতীয় কাজ নির্বাচন কমিশনের পক্ষে রিটার্নিং অফিসার ও সহকারী রিটার্নিং অফিসাররা পালন করে থাকেন। একটি জেলার নির্বাচনের সার্বিক ফলাফল সমন্বয়ের কাজ রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ে সম্পন্ন হওয়া পরবর্তী রিটার্নিং অফিসারকর্তৃক একটি নির্বাচনি এলাকা হতে সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। ফলাফল বিষয়ে রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয় হতে নির্বাচন কমিশনের বরাবর যা প্রেরিত হয় সচরাচর সেটিকেই চূড়ান্ত গণ্যে নির্র্বাচন কমিশন হতে পুনঃ বিজয়ী প্রার্থীর নাম ঘোষণা করা হয়। অতঃপর এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকর্তৃক গেজেট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হলে একজন প্রার্থীর নির্বাচিত হওয়া বিষয়ে সরকারিভাবে আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। সুতরাং সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে রিটার্নিং অফিসার ও সহকারী রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব অপরিসীম। সুষ্ঠু নির্বাচন আমাদের উন্নয়ন, সমৃদ্ধি, স্থিতিশীলতা ও গণতন্ত্রের জন্য অত্যাবশ্যক। নির্বাচনি আইনে রিটার্নিং অফিসার ও সহকারী রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের উপর কোনো বাধ্যবাধকতা না থাকায় সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশবাসী আশা করে, নির্বাচন কমিশন অতীতের ধারাবাহিকতার ব্যত্যয়ে স্বীয় উপলব্ধি হতে উদ্ভাবনমূলক এমন কিছু করবেন যা অতীতের গ্লানির যবনিকাপাতে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে।
সম্পাদনা: আশিক রহমান