রাজনীতি যার যার বিএমএ সবার
ডা. আবুল হাসনাৎ মিল্টন
একটা সময় ছিল বাংলাদেশসহ পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই মাহাত্ম্যের দিক দিয়ে চিকিৎসা পেশার অবস্থান ছিল এক বা দুই নম্বরে। অধিকাংশ দেশেই চিকিৎসকদের সামাজিক সেই অবস্থানটি আজ বদলেছে। তবে বাংলাদেশের মতো এতটা অবনমন বোধহয় খুব কম দেশেই হয়েছে। দেশের অন্যতম মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীরা চিকিৎসা পেশায় এসে পাচ্ছে সামাজিক অসম্মান। শত সীমাবদ্ধতা মাথায় নিয়ে রোগীদের চিকিৎসাসেবা প্রদানের বিনিময়ে ‘কসাইয়ের’ মতো আপত্তিকর উপাধিও পাচ্ছে। কর্মক্ষেত্রে চিকিৎসকদের নিরাপত্তার ঘাটতি প্রকট। ঢাকার বাইরে বিশেষ করে মফস্বলের অবস্থা আরও নাজুক। সেখানে স্থানীয় নেতা, প্রশাসন, মাস্তান সবার হাতেই যেন চিকিৎসকরা জিম্মি। মিথ্যে মেডিকেল সার্টিফিকেটের আবদার থেকে শুরু করে হাসপাতালে কেন ওষুধ নেই, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নেই, সবকিছুর জন্যই চিকিৎসককে দায়ী করা হয়।
আর প্রভাবশালী কারও পরিচিতের মৃত্যু হলে তো কথাই নেই। এমনও দেখা গেছে যে, হাসপাতালে আনার আগেই রোগীর মৃত্যু হলেও ‘চিকিৎসকের অবহেলায়’ বা ‘ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু হয়েছে দাবি করে হাসপাতালে/ ক্লিনিকে ভাঙচুর করা হয়েছে। পাশাপাশি চিকিৎসকদের শারীরিকভাবে লাঞ্চিত করার ঘটনাও ঘটছে অহরহ। অথচ এসব দেখবার যেন কেউ নেই। কর্মক্ষেত্রে চিকিৎসকদের নিরাপত্তা বিধানে একটি আইন প্রণয়নের কথা অনেকদিন ধরেই শুনছি, তবে তা এখনো ধীরগতিতে এগোচ্ছে। যেহেতু চিকিৎসকেরাও মানুষ, সেহেতু চিকিৎসায় ভুল হতেই পারে। তবে চিকিৎসায় ভুল বা চিকিৎসকের গাফিলতি ছিল কিনা সেই সিদ্ধান্ত কে দেবে? রোগীর আত্মীয়-স্বজন, স্থানীয় মাতবর নাকি বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল? বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, স্বাস্থ্যখাতের গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলো হলোÑ নেতৃত্ব ও সুশাসন, পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ, প্রয়োজনীয় জনবল (শুধু চিকিৎসকই নয়, নার্স, প্যারামেডিক্সসহ অন্যান্য পেশাও যার অন্তর্ভুক্ত), ওষুধসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম, স্বাস্থ্য তথ্য ব্যবস্থা এবং স্বাস্থ্যসেবা প্রদান। অথচ আমাদের নীতিনির্ধারকসহ অনেকের কথা শুনলে মনে হয়, স্বাস্থ্যখাত মানে শুধুই ডাক্তার।
স্বাস্থ্যখাতের অন্যান্য উপাদান, বিশেষ করে স্বাস্থ্যখাতে নেতৃত্ব, সুশাসন ও ব্যবস্থাপনার ঘাটতির দায় কার? একজন স্বাস্থ্যমন্ত্রী সে দায় কতটা এড়াতে পারেন? দেশের অন্যতম সেরা মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীরা ডাক্তারি পড়ছে, কিন্তু পাঠ শেষে কতটা দক্ষ, যুগোপযোগী চিকিৎসক আমরা তৈরি করতে পারছি? শ্রদ্ধেয় স্বাস্থ্যমন্ত্রীসহ আমাদের নীতিনির্ধারকরা কি জানেন, দেশের মেডিকেল শিক্ষাব্যবস্থা ভীষণভাবে ত্রুটিপূর্ণ? পৃথিবীতে এখন ‘এভিডেন্সড বেসড প্রাক্টিসের’ যুগ চলছে। এর জন্য তিনটি বিষয় জরুরিÑ প্রথমত চিকিৎসকের জ্ঞান ও দক্ষতা, দ্বিতীয়ত গবেষণালব্ধ ফলাফলের ব্যবহার এবং তৃতীয়ত রোগীর প্রত্যাশা ও মূল্যবোধকে বিবেচনায় নেওয়া। জ্ঞান ও দক্ষতার দিক দিয়ে আমাদের চিকিৎসকরা প্রায় বিশ্বমানের, কিন্তু উন্নত দেশের সঙ্গে আমাদের পার্থক্যটা গড়ে দেয় দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বিষয় দুটো।
বাংলাদেশের চিকিৎসা গবেষণার মান এখনো খুবই দুর্বল, মেডিকেল শিক্ষার সীমাবদ্ধতার কারণে চিকিৎসকদের আমরা গবেষণামনষ্ক করে গড়ে তুলছি না। মেডিকেল শিক্ষায় রোগীর সঙ্গে ব্যবহারের বিষয়টিও প্রায় উপেক্ষিত, অথচ এটি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। স্বাস্থ্যখাতে এ রকম আরও অনেক বিষয় আছে যা নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। দেশ থেকে শারীরিকভাবে দূরে থাকলেও মানসিকভাবে এক মুহূর্তের জন্যও বিচ্ছিন্ন হই না। বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে দেশের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখাটা কোনো ব্যাপারই না। সেইসঙ্গে আছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুক। দেশে কোনো ঘটনা ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই ফেসবুকের কল্যাণে তা মুহূর্তের মধ্যে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। এই ফেসবুকেই হাজার হাজার চিকিৎসকের পেশাগত অসন্তোষ আর আহাজারির কথা শুনি। একটা দেশের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের একাংশকে আমরা কী নিদারুণ এক অসহায়ত্বের দিকে ঠেলে দিচ্ছি। বিশেষ করে যারা সরকারি চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত, তাদের পেশাগত অসন্তোষ চরমে। চিকিৎসকদের পেশাগত পথটা এমনিতেই কঠিন, সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে সেটি কঠিনতর হয়ে পড়েছে। দেশে চিকিৎসকদের অবস্থা এখন নন্দঘোষের মতো। স্বাস্থ্যখাতের যত দোষ সব যেন নন্দঘোষ চিকিৎসকদের। অথচ দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার স্বার্থে, মেডিকেল শিক্ষাব্যবস্থাকে যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে, সর্বোপরি চিকিৎসকদের পেশাগত স্বার্থরক্ষার ক্ষেত্রে দায়িত্ব কাদের? বিড়ালের গলায় ঘণ্টা পরাবে কে?
সঙ্গত কারণেই চিকিৎসকদের প্রাণের সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) কাছেই আমাদের বিপুল প্রত্যাশা। কিন্তু বিএমএ নেতৃবৃন্দ কি সাধারণ চিকিৎসকদের সেই প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছেন? জনগণ ও চিকিৎসকদের অধিকার আদায়ে নেতৃত্ব প্রদানকারী অতীতের সংগ্রামী সেই বিএমএর ধারাবাহিকতা আজ কোথায়? চিকিৎসকরা নানান দলমতে বিভক্ত থাকলেও বিএমএকে আগে আমরা সর্বস্তরের চিকিৎসকদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন হিসেবেই দেখে এসেছি। কিন্তু গত পনের বছরে কি বিএমএ তার সেই সর্বদলীয় চরিত্র হারিয়ে ফেলেছে? বিগত বছরগুলোতে সরকার সমর্থক চিকিৎসক নেতারাই বিএমএতে নির্বাচিত হয়ে আসছেন।
এটার একটা ভালো দিক হতে পারত ধর্মঘট বা আন্দোলন-সংগ্রামের পরিবর্তে আলোচনার মাধ্যমে নিজেদের সমর্থিত সরকারের কাছ থেকে দাবি আদায়। কিন্তু এক যুগেরও বেশি অভিজ্ঞতায় সেটি আমরা তেমনভাবে দেখছি না। তার মানে কি ‘হাত কচলানো’ বিএমএ নেতৃত্ব দিয়ে বিএমএর পক্ষে সাধারণ চিকিৎসকদের দাবি আদায় সম্ভব নয়?
বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমার মনে হয় সরকার সমর্থক হওয়া দোষের কিছু নয়। তবে দাবি আদায়ে নেতৃত্বের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। আমড়া কাঠ দিয়ে যেমন ভালো আসবাবপত্র তৈরি করা যায় না, তেমনি কেবল সরকার সমর্থক হলেই কার্যকর বিএমএ গড়ে তোলা যায় না। এর জন্য চাই সঠিক ও দক্ষ নেতৃত্ব। আগামী ২২ ডিসেম্বর বিএমএর নির্বাচন। এই নির্বাচনে চিকিৎসকদের যোগ্য নেতৃত্বকে নির্বাচিত করতে হবে। ব্যক্তিগত রাজনৈতিক মতামত যাই থাকুক না কেন, চিকিৎসকদের বৃহত্তর স্বার্থে যোগ্য নেতৃত্ব নির্বাচনে যদি চিকিৎসকরা ব্যর্থ হন, তাহলে পেশাগত ভোগান্তি বেড়েই চলবে। সময়ের প্রয়োজনে আজ চিকিৎসকদের সোচ্চার কণ্ঠে আওয়াজ তুলতে হবে, ‘রাজনীতি যার যার বিএমএ সবার’। বিএমএ নির্বাচনের জন্য শুভকামনা।
লেখক: কবি ও চিকিৎসক। বর্তমানে জনস্বাস্থ্য বিষয়ে অধ্যাপনারত
সম্পাদনা: আশিক রহমান