জয়তু মিডিয়া, জয়তু বাংলাদেশ
অজয় দাশগুপ্ত
ধারণা করা হয়েছিল ইলেকট্রনিক মিডিয়ার চাপে মুদ্রণ মিডিয়া বা খবরের কাগজ বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। এমনও ভাবা গিয়েছিল, টিভি যেখানে সারা দিন-রাত খবর দেখাচ্ছে, সেখানে পত্রিকা থাকলেই কি আর না থাকলেই বা কি। আসলে কি তাই? দেখতে দেখতে ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলোও পুরনো প্রাচীন হয়ে গেছে। কিন্তু মুদ্রণ মিডিয়ার জায়গা আগের মতো অটুট। কথায় বলে আখর অবিনশ্বর। তাকে আগলে রাখা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। একটা বিষয় চোখের সামনে এক জায়গায় স্থির থাকা আর চলমান থাকা এক ব্যাপার না। যতবার আপনি ওই একটি বিষয় দেখবেন, ততবার নতুন নতুনভাবে আপনার মনে প্রতিক্রিয়া জন্ম নেবে। তাছাড়া ঘন বসতিও স্বল্প লেখাপড়া জানা মানুষের দেশে আপনি যত ডিজিটাল ডিজিটাল বলুন না কেন, আখেরে ওল্ড ইজ গোল্ড। তাই মুদ্রণ মিডিয়া আছে এবং থাকবে।
আমাদের অর্থনীতি কাগজটির বড় গুণ তার মুদ্রণের পাশাপাশি ইন্টারনেটে ব্যাপক জনপ্রিয়তা। এটা সবাই পায়নি। সংবাদ আপডেট হলেও কলাম বা ফিচারগুলো এক। অথচ মানুষ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সেগুলো পড়ে। সাত মহাদেশে, সাত সমুদ্রের পাড়ের বাঙালির কাছে মুদ্রণের ইলেকট্রনিক দিকটা আজ অতি জনপ্রিয়। তাই এর দায়িত্বও বেশি। দেশব্যাপী উন্নয়ন অগ্রগতি আর সামনে যাবার যে জোয়ার তার সঙ্গে কিছু ভয়, বিপদ আর অনাচারও প্রতিদিন গিলতে হয় আমাদের। আমরা জানি, এমন কিছু খারাপ খবর আছে যা কোনোভাবেই না বলে বা না লিখে থাকা যায় না। এতে বিপদ বাড়ে। মানুষ সচেতন হতে পারে না। আবার এমন কিছু বিপদ বা সাময়িক অসুবিধা আছে যেগুলো নেগেটিভ হলেও পজেটিভ আকারে ছাপা যেতে পারে। কলকাতার বাংলা কাগজের কথাই বলি না কেন, তারা ছোট ছোট সমস্যাগুলো মিটে যাবার পর সেগুলো নিয়ে খবর ছাপে। একবার একটা দেয়াল ধসে পড়ে যাবার পরও তারা বলেনি। কারণ ছিল, মানুষের মনে ভীতির উদ্রেক হতে না দেওয়া। আর আমরা? রানা প্লাজার দেয়াল চাপা পড়া মানুষের মুখের কাছে মাইক্রফোন নিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম, কখন তার প্রাণ যায় সে আশায়। সাংবাদিকতা ও সাংবাদিককে আজ ঈগল বা পায়রার পরিবর্তে শকুন বানানোর এক অপচেষ্টা দেখি। এটা বন্ধ করা উচিত।
দুধ বাড়ি বয়ে দিয়ে আসতে হবে আর মদ মানুষ শুঁড়িখানায় গিয়ে খায়। তাই বলে কি মদ কোনো ভালো পানীয়? ভালো জিনিসের স্বভাব এমনই সে কড়া ডোজ হয় না। কিন্তু কাজ করে ধীরে ধীরে এবং তা সমাজ ও জাতির জন্য মঙ্গলের। দেখবেন, পরিশ্রমী কোনো কৃষক, কোনো উদ্ভাসিত চাষী বা লেখাপড়া কিংবা মেধায় দেশকাঁপানো কেউ সহজে শিরোনাম হয় না। শিরোনামে আছেনÑ চোর, বাটপার, ডাকাত বা ধর্ষক কেউ। এভাবে আমরা এমন এক নেগেটিভ সমাজ তৈরি করে ফেলেছি যেখানে অজান্তেই প্রতিদিন কোনো খারাপ খবরের দুরাশায় থাকছি আমরা। অথচ এদেশে এখনো একজন নবজাতকের আগমন হচ্ছে আনন্দের সেরা ঘটনা। এখনো কোনো মেয়ের বিবাহ বা কারও কৃতকার্যতায় আনন্দের বান ডাকে। মানুষে মানুষে মিলন না থাকলে ঈদ-শারদীয় উৎসব প্রচারণার ফানুস আকাশ স্পর্শ করতে পারত না। সেগুলোকে গৌণ করে আমরা ছুটি জঙ্গি আর খুন বা যৌনতার পেছনে।
আশা করছি, এই কাগজ তার নিজ ভূমিকায় সে দূরাশাগুলোকে গৌণ করে মানুষকে মুখ্য করে তুলবে। মানুষ বা পাঠকের আশা জাগাতে না পারলে কোনোদিনও কিছু টেকেনি। সে কথাটা আজ বাংলাদেশের যেকোনো মিডিয়ার জন্য চরম সত্য। ষোল কোটি মানুষের শ্রমে, আনন্দে, বেদনায়, ভালোবাসায় বহতা নদীর মতো দেশটিকে মা মনে করলে তার যাবতীয় দোষ একপাশে সরিয়ে তাকে অন্য আলোয় দেখা যায়। সে আলোতে ভোরবেলায় গরম চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে আমরা যেন বলতে পারি; বাহ এইতো আমাদের দেশ। একমাত্র মানুষ ক্রিকেট পারে, হিমালয় জয় করতে পারে, নোবেল পেতে পারে। এই দেশে জন্মে আমরা ধন্য। যে দেশ আমাদের জগত খুলে দিয়েছে, মিডিয়া খুলে দিয়েছে তার জন্য এটুকু করব না আমরা?
জয় হোক মিডিয়ার। জয় হোক বাংলাদেশের।
লেখক: সিডনি প্রবাসী, কলামিস্ট ও বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষক
সম্পাদনা: আশিক রহমান