সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে দেয়ালচিত্র এঁকেছি
হাসেম খান
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অধিকার নিশ্চিত করেছে। আমরা এই অধিকার নিশ্চিত করেছি মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। লাখো মানুষের রক্তের বিনিময়ে। মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে তৎকালীন সাড়ে সাত কোটি বাঙালি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। বঙ্গবন্ধু সেদিন বলেছিলেন, তোমরা ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো এবং যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। তার এ আহ্বানের পরই শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। তখন শুধু বাঙালিরাই নয়, সারাবিশ্বের স্বাধীনতাকামী জনতা বঙ্গবন্ধুর আবেগী উচ্চারণে শত্রুদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পেরেছিল। তিনি তার বক্তৃতায় তখন বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষকে একত্র করতে পেরেছিলেন। ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক, দিনমজুর, ব্যবসায়ী, চিত্রশিল্পী, অভিনয়শিল্পী, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী সবাই স্বাধীনতার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এবং স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল পাকিস্তানের কাছ থেকে। তখন আমি ছিলাম তরুণ, আমরা কয়েকজন শিল্পকলায় ছাত্র অবস্থায় আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিলাম। আমি একটি সরকারি চাকরি পেয়েছিলাম। চাকরি করার মধ্য দিয়েই আমি তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের হয়ে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ি। চাকরির তোয়াক্কা না করেই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। তৎকালীন পাকিস্তানি সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বিভিন্ন স্থানে আল্পনা এঁকেছি, চিত্র এঁকেছি, দেয়ালচিত্র এঁকেছি। তখন সরকারের বিরুদ্ধে আল্পনা, চিত্রশিল্প করা একপ্রকার নিষিদ্ধ ছিল। তারপরও আমিসহ আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে এ সকল কাজ করেছিলাম।
শিল্পকলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার পর থেকে মানুষের জন্য, মানবতার জন্য ছবি আঁকা শুরু করি। তখন থেকে দেশে যত আন্দোলন হয়েছিল, সবকিছুতেই আমরা সমানভাবে অংশগ্রহণ করে বিভিন্ন আল্পনা, ছবি, দৃশ্য ও দেয়াললিখন লিখতাম। তখন আল্পনা একরকম সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। এই কাজটি আসলে দেশের সংস্কৃতি হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত ছিল। তখন হিন্দু, মুসলিম কোনো ভেদাভেদ ছিল না, সবাই মিলে দেশের জন্য কিছু করতে পারি কিনা সেই চিন্তাই সবসময় করতাম আমরা। গ্রামের অনেক মেয়েদের চালের গুড়া দিয়ে বিভিন্ন উৎসবে আল্পনা আঁকতে দেখেছি। তখন আল্পনা বাঙালিয়ানার শিল্পচর্চার শুদ্ধ হওয়া, পরিচ্ছন্ন হওয়া, পরিষ্কার হওয়ার প্রতীক হিসেবে বেশি পরিচিত ছিল। আমরা যারা ছাত্র ছিলাম তারা বিভিন্ন বাধা পেয়ে আরও বেশি কর্মতৎপর হয়ে উঠেছিলাম। শিল্পকলায় পড়াশোনা করে জ্ঞান অর্জন করে ছবির প্রদর্শনী করাই কিন্তু শিল্পকলার মূল উদ্দেশ্য নয়। শিল্পকলার জ্ঞান অর্জন করে দেশের ক্রান্তিকালে যথাযথ ভূমিকা রাখাই মূখ্য উদ্দেশ্য। জীবনযাপনের লক্ষ্যে শিল্পকলাকে প্রবিষ্ট করা, প্রতিষ্ঠা করাই এর লক্ষ্য হওয়া উচিত। সবক্ষেত্রেই শিল্পীরা দেশকে ভালোবাসেন, দেশের মানুষকে ভালোবাসেন দেশের উন্নয়নে, দশের উন্নয়নে।
এখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার ক্ষমতায় রয়েছে, তারা অনেক বৈপ্লবিক কাজ করে চলেছে। তারা লড়াই করছে বাংলাদেশকে একটি সমৃদ্ধশালী দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে। যাতে প্রতিটি ক্ষেত্রেই মানুষের কল্যাণ হয় এমন কার্যক্রমই চালাচ্ছে। একইসঙ্গে চিত্রশিল্পীদের মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য, তাদের উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
পরিচিতি: চিত্রশিল্পী
মতামত গ্রহণ: শরিফুল ইসলাম/সম্পাদনা: আশিক রহমান