বিডিনিউজকে তার সীমাবদ্ধতা সমেতই অভিনন্দন জানাই
ফিরোজ আহমেদ
দেশের প্রথম অন্তর্জাল সংবাদপত্র ‘বিডিনিউজ২৪’ দশবছর অতিক্রম করেছে। এই সুযোগে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও গণপ্রতিনিধিত্ব বিষয়েও দু’চার কথা বলি। বিডিনিউজে এক সময়ে আমার নিয়মিত লেখার অভিজ্ঞতা ছিল, সেখানকার বন্ধুদের অনুরোধ তো ছিলই, সঙ্গে ছিল এমন একটা পরিসরে নিজেকে প্রকাশ করার সুযোগও।
আমি প্রথমবার বিডিনিউজে লেখা বন্ধ করেছিলাম আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সহযোদ্ধা আবুল হাসান রুবেলের একটা লেখা নিয়ে বিডিনিউজে একটা অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার ফলশ্রুতিতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার তৎকালীন কর্তা ফ্রাসকেল লামিকে প্রধান বক্তা করা হয়োছিল ২০১২ সালে। তো, আবুল হাসান রুবেল দেখিয়ে দিলেন তার লেখায়, বাংলাদেশের শিক্ষা সঙ্কোচনের সঙ্গে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। লেখাটা নিছকই তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণী লেখা, রুবেলকে যারা চেনেন, জানবেন, অযৌক্তিক কথা লেখাটা তার ধাতে নেই। বিডিনিউজ লেখাটা ঘণ্টা কয়েক পর নামিয়ে নিল। আমার সব সময়েই মনে হয়েছে, লেখাটা তারা ছাপার জন্য মনোনীত করার পর গুরুতর কোনো গলদ না থাকলে এটা নামিয়ে নেওয়াটা লেখকের প্রতি মারাত্মক অসৌজন্যতার পরিচায়ক। বরং তারা আরেকটি ভিন্নমত সংবলিত লেখাই প্রকাশ করতে পারত।
দ্বিতীয়বার বিডিনিউজের কাছে ধাক্কা খাই, বিডিনিউজ একটা সমাবেশের শিরোনাম করে: ‘বিএনপি দেউলিয়া বলে জনগণ অসহায়: সাকি।’ সঙ্গে সেই রকম এক উপশিরোনামও: ‘আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের ‘সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্রের’ বিরুদ্ধে আন্দোলনে বিএনপির সক্রিয়তা প্রত্যাশা করেছেন গণসংহতি আন্দোলনের নেতা জোনায়েদ সাকি’। ভিতরেও এমনি সব আজগুবি বাক্য।
পত্রিকায় যাদের প্রতিবাদলিপি পাঠাবার অভ্যাস আছে, তারা জানেন, পত্রিকাওয়ালারা কত ঘোড়েল, তাদের কাছ থেকে দুঃখপ্রকাশ বা ক্ষমাপ্রার্থনা আশা করা তো অবান্তর, ভুল স্বীকারও তারা খুব বিপদে পড়লে করেন না। ভাগ্যক্রমে, ওইদিন পুরো বক্তৃতা ধারণ করা ছিল। সেটা আমরা অন্তর্জালে তুলে দিয়ে দেখাই, জোনায়েদ সাকি বিএনপিকে দেউলিয়া বলেছেন, তাদের গণশত্রুতার সমালোচনা করেছেন। সরকারকে স্বৈরতান্ত্রিক বলেছেন। এদের প্রভাবমুক্ত হয়ে জনগণের রাজনৈতিক শক্তিই যে গড়ে তুলতে হবে, সেই আহ্বান জানিয়েছেন। বিডিনিউজ পরবর্তীতে সংবাদটি সংশোধন করেছিল, কারণ অন্তর্জালের কল্যাণে আমরাও সম্পূর্ণ বক্তৃতাটি প্রচার করতে পেরেছিলাম। কিন্তু এই ধারণকৃত বক্তৃতাটা না থাকলে নিজেদের বানানো খবরই তারা চালিয়ে দিত, ইতিহাসেও তাই থেকে যেত। ভবিষ্যতে কি হবে কে বলতে পারে! কিন্তু বিডিনিউজের এই ব্যাখ্যাহীন শত্রুতা আমার স্মৃতিতে স্থায়ী দাগ কেটেছে। গণমাধ্যমের বিপুল ক্ষমতার সামনে আমরা কতটা অসহায়, প্রতিকারহীন, সেই উপলদ্ধি বিডিনিউজ আমাদের দিয়েছিল। কখনো স্মৃতিকথা লিখলে এই ঘটনা তাতে নিশ্চয়ই ঠাঁই পাবে।
তাই বলে আমরা পুরো প্রত্রিকার পাইনি। অসংশোধিত ওই কয়েক ঘণ্টায় জোনায়েদ সাকি কিংবা গণসংহতি আন্দোলেনর ভাবমূর্তির যে ক্ষতি তারা করেছিলেন, সেই রকম দুঃখপ্রকাশ বা সংশোধনীমূলক বক্তব্য তারা কিন্তু দেননি। ফলে খবরটি যারা একবার পড়েছেন, তারা ওই ধারণা নিয়েই থেকেছেন।
পত্রিকার কাছে আসলে কি আশা করব, তার নির্ণয় কঠিন। বাংলাদেশের অধিকাংশ সংবাদকর্মীকে আমি যতদূর চিনি, তারা রামপালে কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরুদ্ধে। মোসাহেব কিছু মালিক-কর্তৃপক্ষই এই প্রকল্পের ধামাধরা। ফলে, সরকারের প্রবল চাপের মুখেও ফাঁকে-ফোঁকরে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিপদ নিয়ে, উন্মুক্ত কয়লা খনির ভয়াবহতা নিয়ে প্রতিবেদন তারা প্রকাশ করেছে। বিডিনিউজ ব্যতিক্রম সম্ভবত। বাংলাদেশের শীর্ষতম অন্তর্জাল সংবাদপত্রটি পড়লে আপনি নাও জানেত পারেন যে, বড় পুকুরিয়ার উন্মুক্ত কয়লা খনি স্থানীয় জনসাধারণের জীবনে কি ভীষণ প্রতিকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। রামপালে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের পক্ষে আনজুমান আরা নামের কাউকে তারা হাজির করেছিল। কল্লোল মুস্তফার লেখাগুলো তারা জবাব হিসেবে ছেপেছে বটে, কিন্তু সংবাদপত্রের কায়দা কৌশল যারা জানেন, তারা বুঝবেন, রামপালে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের সমর্থক এই পত্রিকাটি।
কিন্তু এই সীমাবদ্ধতা বাকি সব পত্রিকারই রয়েছে। মাইক্রোবিডস নামে অনুসন্ধান করলে আপনি বিডিনিউজে কিছু পাবেন না। প্রথম আলোতেও নাও পেতে পারেন। ডেইলি স্টারে পাবেন, কিন্তু ইউনিলিভারের নাম পাবেন না। কারণ তারা বড় বিজ্ঞাপনদাতা। বিষয়টা ভয়াবহ এই কারণে যে, বিশ্বব্যাপী প্রসাধনী ও পরিষ্কারকারী পণ্যে মাইক্রোবিডসের উপস্থিতিকে ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য ও প্রকৃতির প্রতি বিশাল হুমকি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু বিজ্ঞাপনের শক্তির কারণেই বাংলাদেশে এই বিষয়ে চুপচাপ থাকে গণমাধ্যম, কেবল গত সপ্তাহে বণিক বার্তাকেই এই বিষয়ে মুখ খুলতে দেখলাম। এই একটি ঘটনাই বলে দেবে, সংবাদকর্মীরাও কত অসহায় দিন কাটান বিজ্ঞাপনদাতা কিংবা নীতিনির্ধারকদের স্বার্থ ক্ষুণœ হবার সম্ভাবনা সৃষ্টি হলে।
এরপরও বিডিনিউজ অল্প কিছু সংবাদমাধ্যমের মতোই শ্রদ্ধা আর বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করেছে, গুজব, যৌনতা এবং চটকদার সংবাদের বাণিজ্য না করেই এটা শীর্ষস্থানে গিয়েছে এবং সেই ধারাবাহিকতা রক্ষাও করেছে। এদিক দিয়ে তারা বিশেষভাবে অভিনন্দন পাবার যোগ্য। এই সংবাদপত্রটিতে আমার বেশকিছু বন্ধু এবং সুহৃদ ও শুভানুধ্যায়ী আছেন, এই সুযোগে তাদের সকলকেই শুভেচ্ছা জানাই। তাদের সাহিত্য পাতার মান বেশ ভালো, বলতে কি, মতামত বিশ্লেষণও আগে খুবই ভালো ছিল, সরকারের সমালোচনা সীমিত আকারে ছাপা শুরুর পর থেকে তাদের বিষয়ে প্রশংসা আর করতে পারি না। বরং সরকারের প্রতি বিশেষ অনুকূল হলেও সমালোচনার ধারাবাহিকতা রক্ষা করে বলে বাংলাট্রিবিউন আমার এখন পছন্দের। কেননা, সমালোচনার সাহস আর মেরুদ-ই যদি না থাকল, কিসের সংবাদপত্র। কিন্তু দশ বছর এই মান ধরে রাখা খুব সহজ না, বিডিনিউজকে তার সীমাবদ্ধতা সমেতই অভিনন্দন জানাই। প্রাণবন্ত কাটুক তাদের আগামী।
লেখক: কেন্দ্রীয় সদস্য, গণসংহতি আন্দোলন। সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন/ফেসবুক থেকে…