অর্থঋণ আদালত : আইন ও বিচার পদ্ধতি
মো. আবুল কালাম আজাদ
অর্থঋণ আদালত আইন, ২০০৩ এর অধীনে মামলার কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিচার পদ্ধতি তুলে ধরা হয়েছে, আর যেসব ক্ষেত্রে বিচার পদ্ধতির বর্ণনা পাওয়া যায় না সেই ক্ষেত্রে দেওয়ানি কার্যবিধি প্রয়োগ করা হয়।
মামলার বাদি, আর্থিক প্রতিষ্ঠান এই আইনের ৮ নম্বর ধারার অধীনে আরজি দাখিলের মাধ্যমে মামলা দায়ের করবে। আরজির সঙ্গে দালিলিক প্রমাণাদি দাখিল করতে হবে এবং আরজির বক্তব্য ও দালিলিক প্রমাণাদির সমর্থনে একটি হলফনামা আরজির সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। সেই সঙ্গে মূল্যানুপাতিক কোর্ট ফি প্রদান করতে হবে। আরজিটি যথাযথ হলে অর্থঋণ মামলা হিসেবে নির্ধারিত রেজিস্ট্রারে অন্তর্ভুক্ত হবে।
উল্লেখ্য, যে ক্ষেত্রে ঋণের বিপরীতে স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি বন্ধক রাখা হয়, সে ক্ষেত্রে বাদি আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে অবশ্যই মামলা দায়েরের পূর্বে ধারা ১২ এর বিধান সাপেক্ষে বন্ধককৃত সম্পত্তি নিলামের মাধ্যমে বিক্রয়ের চেষ্টা করতে হবে। বিবাদী মূল ঋণ গ্রহীতা কিংবা ঋণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তৃতীয় পক্ষ বন্ধকদাতা এবং তৃতীয় পক্ষ গ্যারান্টরকেও বিবাদী শ্রেণিভুক্ত করতে হবে। বিবাদী বা বিবাদীদের প্রতি সমন জারি করতে হবে। আইনের ৭ নম্বর ধারায় সরাসরি, বিকল্প পদ্ধতি এবং অতিরিক্ত সমন জারির বিধান বর্ণিত আছে। সমন জারির পর, বিবাদীগণ ৯ ধারা অনুসারে ও ১০ ধারায় বর্ণিত সময়সীমার মধ্যে লিখিত জবাব দাখিল করবে এবং মামলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবে। বিবাদী লিখিত জবাবের সঙ্গে দালিলিক প্রমাণাদি এবং সেই সঙ্গে একটি হলফনামা দাখিল করতে হবে। যদি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বাদী লিখিত জবাব প্রদান না করে তাহলে একতরফাভাবে মামলা নিষ্পত্তি হয়ে যাবে।
বাদী ১১ ধারা অনুসারে লিখিত জবাবের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত জবাব দাখিল করতে পারবে, কিন্তু বিবাদীর অতিরিক্ত জবাব দাখিলের কোনো সুযোগ নেই। ১৩(১) ধারা অনুসারে লিখিত জবাব দাখিলের পর আদালত উভয়পক্ষকে মৌখিক শুনানি শেষে কিংবা তাদের অনুপস্থিতিতে মামলার বিচার্য বিষয় গঠন করবে। আর বিচার্য বিষয় না থাকলে আদালত অবিলম্বে রায় প্রদান করবেন। তবে আদালত মৌখিক যুক্তিতর্ক শুনতে বাধ্য নন। সাক্ষ্য সমাপ্ত হবার দশ দিনের মধ্যে রায় প্রদান করার বিধান রয়েছে আইনের ১৬ ধারায়।
অর্থঋণ আদালত আইন, ২০০৩ এ বিবাদী উপস্থিত হলে মধ্যস্থতা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে ২২ ধারায়। বিবাদী জবাব দাখিলের পর আদালতের সহায়তায় মধ্যস্থতার বিধান আছে। এছাড়াও ৩৮ ধারাতেও জারির পর্যায়ে মধ্যস্থার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তির বিধান রয়েছে।
অর্থঋণ আদালতের রায়, আদেশ বা ডিক্রি চূড়ান্ত এবং এই রায়, আদেশ বা ডিক্রির বিরুদ্ধে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না। আদালতের আদেশ বা রায়ে ডিক্রিকৃত টাকা ৬০ দিনের মধ্যে যেকোনো একটা সময়সীমা নির্ধারণ করে তার মধ্যে পরিশোধের জন্য বিবাদীকে নির্দেশ প্রদান করবেন। আইনের ১৭ ধারায় মামলা নিষ্পত্তির সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে যা বিবাদী হাজির হলে ৯০ দিন এবং হাজির না হলে ৩০ দিনের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করতে হবে। তবে যথাযথ কারণ থাকলে ৯০ দিনের সঙ্গে আরও ৩০ দিন যোগ করা যাবে। সময়ের হিসাব গণনার বিধান রয়েছে ৪৮ ধারায়। একতরফা ডিক্রি প্রদান এবং রদের বিধান বর্ণিত হয়েছে ১৯ ধারায়।
ডিক্রি জারির বিধান বর্ণিত হয়েছে ২৬ থেকে ৩৯ ধারায়। অর্থঋণ মামলার ডিক্রি মূলত টাকা আদায়ের ডিক্রি। তবে এই ডিক্রি জারি সংক্রান্ত নিলাম, গ্রেফতার ও দেওয়ানি আটক ইত্যাদি বিষয়ে কিছু বিধানাবলি সংযোজন করা হয়েছে। ডিক্রি জারি কার্যক্রমের ক্ষেত্রে অর্থঋণ আদালত আইন ২০০৩ এবং দেওয়ানি কার্যবিধির মধ্যে অসামঞ্জস্যতা দেখা দিলে অর্থঋণ আদালত আইনই প্রাধান্য পাবে। অর্থঋণ আদালতে বিবাদীর বিরুদ্ধে ডিক্রি হয় টাকা আদায়ের জন্য এবং বন্ধকী সম্পত্তি নিলাম বিক্রয়ের জন্য।
বন্ধকী সম্পত্তি নিলাম বিক্রির ডিক্রি জারি করা যাবে বন্ধকী সম্পত্তি নিলাম বিক্রির মাধ্যমে এবং টাকার ডিক্রি জারি করা যায় দায়িককে দেওয়ানি কয়েদে আটক রাখার মাধ্যমে অথবা তার সম্পত্তি ক্রোক ও নিলাম বিক্রির মাধ্যমে বা উভয় পদ্ধতির মাধ্যমে। জারি মামলায় তৃতীয় পক্ষ দেওয়ানি কার্যবিধি আইনের বিধান মতে দাবি সম্বলিত আবেদন পেশ করলে ৩২(২) ধারা অনুসারে ডিক্রির অনাদায়ী অংশের ১০% জমা প্রদান করলে ৩২ ধারার বিধান মতে আদালত বিবেচনা করলে এই আবেদন মিস মামলা হিসেবে রেজিস্ট্রিভুক্ত হবে।
৪১ এবং ৪২ ধারায় যথাক্রমে আপিল ও রিভিশনের বিধানাবলি বর্ণিত আছে। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল দায়ের করা যাবে, তবে অর্থঋণ আদালতের অন্তর্বর্তী আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করা যাবে না, সে ক্ষেত্রে রিট মামলা দায়ের করা যাবে। আপিল বা রিভিশনের যেকোনো পর্যায়ে মধ্যস্থতার মাধ্যমে মামলার নিষ্পত্তি করা যাবে, কিন্তু সে ক্ষেত্রে আদালতকে অবহিত করতে হবে।
অর্থঋণ আদালতের রায়, আদেশ বা ডিক্রি সকল বিবাদিগণের বিরুদ্ধে যৌথ ও পৃথকভাবে কার্যকর হবে। ডিক্রি জারির মামলা সব বিবাদি-দায়িকের বিরুদ্ধে একই সঙ্গে পরিচালিত হবে। কাউকে বাদ দেওয়া যাবে না। ডিক্রি জারির মাধ্যমে দাবি আদায় হওয়ার ক্ষেত্রে আদালত প্রথমে মূল ঋণ গ্রহীতার সম্পত্তি যতদূর সম্ভব আকৃষ্ট করবেন। মূল ঋণ গ্রহীতার সম্পত্তির পরও যদি দাবি আদায় না করা যায় তাহলে তৃতীয় পক্ষ বন্ধকদাতা ও তৃতীয় পক্ষ গ্যারান্টরের সম্পত্তি যতদূর সম্ভব আকৃষ্ট করার ব্যবস্থা করতে হবে। তৃতীয় পক্ষ বন্ধকদাতা ও তৃতীয় পক্ষ গ্যারান্টর যদি দাবি পরিশোধ করে তাহলে ডিক্রি তাদের অনুকূলে স্থানান্তরিত হবে এবং তারা মূল ঋণ গ্রহীতার বিরুদ্ধে তা প্রয়োগ করতে পারবেন।
লেখক: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট। চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লিগ্যাল ডেভেলপমেন্ট
সম্পাদনা: আশিক রহমান