নয়া স্নায়ুযুদ্ধের কালপর্বে আমাদের পৃথিবী
মোহসীন আব্বাস: মধ্যপ্রাচ্যের সাম্প্রতিক আলোচিত শহর আলেপ্পো ও মসুল। একটি সিরিয়ার শহর অন্যটি ইরাকের। আলেপ্পোতে আইএসবিরোধী লড়াই করছে সিরিয়ার সরকারি বাহিনী ও রুশ সামরিক ইউনিট। মসুলে আইএসবিরোধী অভিযান পরিচালনা করছে মার্কিন সমর্থিত ইরাকী বাহিনী, কুর্দি যোদ্ধা ও সীমিত আকারে তুরস্কের সামরিক বাহিনী। তুরস্কের মাথাব্যথার কারণ যতটা না আইএস, তার চেয়ে বেশি কুর্দিবাহিনী। আমেরিকার লঘু যন্ত্রণা আইএস, গুরু যন্ত্রণা সিরিয়ার সরকার। রাশিয়ার মনোভাব সিরিয়ায় উপস্থিতি বজায় রাখা ও বিশ্বকে দেখানো যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পর রুশ রাষ্ট্রের অবস্থা আর এখনকার অবস্থা এক নয়। তবে রুশদের একটা ইতিবাচক দিক হলো আমেরিকার মতো তারা মধ্যপ্রাচ্যে কোনো রাষ্ট্র ধবংস করতে চাইছে না। আমেরিকা চায় ইরাক ও সিরিয়া ভেঙ্গে কয়েকটি ক্ষীণ শক্তির রাষ্ট্রের উদ্ভব হোক, তুরস্ক চায় যা-ই হোক না কেন, কুর্দিরা যেন তাদের নিজস্ব ভূমি না পায়। এমন পরিস্থিতিতে পশ্চিমা দুনিয়া আবার ¯œায়ু যুদ্ধের গন্ধ পাচ্ছে।
রুশ নেতা পুতিন মনে করছেন যুক্তরাষ্ট্রের বারাক ওবামা প্রশাসন কোনো আলোচনা চাচ্ছে না, বরং রাশিয়াসহ সারা দুনিয়াকে অঙ্গুলি নির্দেশে চলতে বাধ্য করতে চাইছে। এমন মনোভাবের পর স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে আলোচনা ও উত্তেজনা কি এখন থেকে এ সঙ্গে পথ হাঁটবে।
উত্তরটা মোটেও জটিল নয়। অবশ্যই উত্তেজনা থাকবে এবং আলোচনা-আলোচনা খেলাও থাকবে। যা দৃশ্যত গত শতকের ¯œায়ু যুদ্ধের মতো না হলেও এক ধরনের ¯œায়ু যুদ্ধতো অবশ্যই। গত শতকের ¯œায়ু যুদ্ধের অবসানের পর এক নতুন ব্যবস্থার বিশ্ব গড়ে উঠছিল। আজকের বাস্তবতাকে প-িত-চিন্তকদের অনেকে নয়া-¯œায়ুযুদ্ধ বলতে চাইছেন, অনেকে এটাকে শীতল শান্তির যুগ বলতে চান। আমরা বলতে চাই নামে কী আসে যায়? পৃথিবী আবার উত্তেজনার যুগে প্রবেশ করছে একথা তো সত্য। আলেপ্পো, মসুল বা মধ্যপ্রাচ্য অথবা পীত সাগর বা ভারত সাগর এই উত্তেজনার অজুহাত মাত্র।
যুদ্ধ সবসময়ই রাজনীতি। রাজনীতি সবসময়ই যুদ্ধ। যুদ্ধ যখন রক্তপাতহীন তখন তা রাজনীতি, আর রজনীতি যখন রক্তপাতময় তখন তা যুদ্ধ। একথা গত শতকের এক মহৎ রাষ্ট্রনায়কের। পৃথিবী এখনো এ মত ভেঙে নতুন কোনো রাজনীতির সূচনা করতে পারেনি। মানুষের সভ্যতা একই সঙ্গে অখ- ও বিভক্ত। আন্তর্জাতিক ও জাতীয়। একারণেই বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে রাষ্ট্রের প্রতি রাষ্ট্রের স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠা পেলেও সীমান্ত সংঘাত, গোয়েন্দাবৃত্তি, তেলের লড়াই, কূটনৈতিক দড়ি টানাটানি, বাজার দখলের কৌশলী প্রতিযোগিতা বন্ধ হয়নি। এই দ্বন্দ্ব-সংঘাতের রূপ বদলায় ক্রমাগত। গত শতকের ¯œায়ুযুদ্ধ একটা আদর্শিক রূপও পেয়েছিল। সোভিযেত ইউনিয়নে পতনের পর আর সেই আদর্শিক রূপটি থাকেনি। ফলে চিন্তকগণ বিশেষ করে পশ্চিমের চিন্তকগণ প্রচার করতে থাকেন ¯œায়ুযুদ্ধের অবসান হয়েছে। দ্বন্দ্ব-সংঘাতের এ দুনিয়ায় আমেরিকার সামনে বড় প্রতিযোগী না থাকায় মনে হচ্ছিল পৃথিবী এককেন্দ্রিক হয়ে গেছে। কার্যত দুনিয়া ভাগ হয়ে যায় বহুকেন্দ্রে। প্রবল প্রতাপের আমেরিকা এটাও মানতে চায়নি। ফলে জ্বালানি, পানীয়জল, কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ জল ও স্থলভাগের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণের জন্য মরিয়া তারা। অনেক ভাঙা-গড়ার পর রুশ ফেডারেশন বিকশিত হয় ততদিনে। বিকশিত হয় চীন, ভারত, উত্তর কোরিয়া, ইরান, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা ও জাপান। আর চলমান যুদ্ধের রূপও বদলে যায় সময়ের হাত ধরে। রাষ্ট্রের, অঞ্চলের এবং অর্থনীতির চরিত্র বদলে যায়। পৃথিবী প্রবেশ করে এক আন্ত-সম্পর্ক ও আন্ত-নির্ভরশীলতার জটিল ব্যবস্থায়। এ ব্যবস্থায় আর সোহরাব-রোস্তমের আমলের জোর-জবরদস্তি দেখানোর পরিস্থিতি থাকেনি। বড় বা ছোট, রাষ্ট্রগুলোর অভ্যন্তরীণ, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রের নানা উপাদান আন্ত-রাষ্ট্রীয় সম্পর্কের নিয়ামক হয়ে দাঁড়ায়। এমন পরিস্থিতিতে বড় রাষ্ট্রগুলোর প্রভাব বাড়ানোর কৌশল বদল করতে হয়। পরিবর্তিত কৌশলের হাত ধরে আসে রাষ্ট্র ধবংসের পরিকল্পনা, আঞ্চলিক যুদ্ধ, শান্তির নামে পররাষ্ট্রে হস্তক্ষেপসহ নানা উত্তেজনাকর নীতি। এ উত্তেজনা সার্বিকভাবে আবার পৃথিবীকে বিভক্ত করে তুলেছে।
ন্যাটোর পক্ষ থেকে সম্প্রতিক সময়ে বলা হয়েছে, এই জোট নতুন করে কোন ¯œায়ুযুদ্ধে প্রবেশ করতে চায় না। এটা ন্যাটোর ইউরোপীয় সদস্যদের চাওয়া। ইউরোপের পরিস্থিতি এখন ¯œায়ুযুদ্ধের চাপ সামলানোর মতো নয়। মধ্যপ্রাচ্য সংকট থেকে উৎসারিত অভিবাসী সমস্যা ইউরোপকে নাড়িয়ে দিয়েছে। ব্রেক্সিট ইউরোপীয় ইউনিয়নের ধারণা ও দর্শনকে চ্যালেঞ্জ করেছে। অর্থনৈতিক মন্দা, বেশকিছু ইউরোপীয় সমৃদ্ধ দেশকে হতদরিদ্র করেছে। পূর্ব ইউরোপের অনেক দেশ পশ্চিমের মিত্র হলেও রুশ ফেডারেশনের প্রভাব বলয়ের বাইরে নয়। এমন পরিস্থিতিতে ইউরোপীয় ন্যাটো সদস্যদের পক্ষে ¯œায়ু যুদ্ধের চাপ সহ্য করা কঠিন।
মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি, আরব দেশগুলোর আর্থ-রাজনৈতিক অবস্থা, এশিয়ার উত্থান, আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতি আঞ্চলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণদেশগুলোতে নীতি পরিবর্তন আনছে। চলছে জোট গঠন-পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া। এ অস্থির সময়কে নতুন শীতল যুদ্ধের কাল বলতেই হয়। চিন্তকগণ আগামীর ¯œায়ুযুদ্ধের আশঙ্কায় গলদঘর্ম হতে পারেন। বাস্তবতা হচ্ছে সভ্যতা নয়া ¯œায়ুযুদ্ধে ইতোমধ্যেই প্রবেশ করেছে। সম্পাদনা : আলাউদ্দিন