সাবেক আইনমন্ত্রী একমত হলেও ভিন্ন বর্তমান আইনমন্ত্রীর বিচার বিভাগে দ্বৈত শাসনের অবসান চান প্রধান বিচারপতি
নাশরাত আর্শিয়ানা চৌধুরী ও এস এম নূর মোহম্মদ: প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা ১৯৭২ সালের সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদটি পুনঃপ্রবর্তন করার কথা বলেছেন। তার সঙ্গে একমত সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, তবে ভিন্নমত বর্তমান আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হকের। তার মতে, নির্বাহী বিভাগ কাজ করলেও বিচারবিভাগের মত নিয়েই করা হয়। আর অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলম বর্তমানে বিধানে তেমন কোনো সমস্যা উপলব্ধি করছেন না। বিশিষ্ট আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, ১৯৭২ সালের বিধানটি ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন বলেন, এখন আর মন্ত্রণালয় থেকে এককভাবে কোনো কিছু করা যায় না। গতকাল সোমবার বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের ৯ বছর (আজ মঙ্গলবার) উপলক্ষে দেওয়া এক বাণীতে প্রধান বিচারপতি বলেন, সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদে অধঃস্তন সব আদালত ও ট্রাইব্যুনালের উপর হাইকোর্টের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ থাকবে বলা হয়েছে। কিন্তু ১১৬ অনুচ্ছেদে যে বিধান দেওয়া হয়েছে তা বিচার বিভাগের ধীরগতির অন্যতম কারণ। এ অনুচ্ছেদ অনুসারে অধঃস্তন আদালতের বিচারকদের পদোন্নতি, বদলি এবং শৃঙ্খলামূলক কার্যক্রম সুপ্রিম কোর্টের পক্ষে এককভাবে গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না। দ্বৈত শাসনের ফলে বহু জেলায় শূন্য পদে সময়মত বিচারক নিয়োগ প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে বিচার কাজে বিঘœ ঘটে এবং বিচারপ্রার্থী জনগণের ভোগান্তি বেড়ে যায়। এ প্রেক্ষাপটে ১৯৭২ সালের সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদটি পুনঃপ্রবর্তন করা সময়ের দাবি। আগের বিধানে বলা আছে, বিচার-কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচার বিভাগীয় দায়িত্বপালনরত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল, পদোন্নতি, ছুটি মঞ্জুরিসহ) ও শৃঙ্খলাবিধান সুপ্রিম কোর্টের উপর ন্যস্ত থাকবে। উক্ত বিধানটি পুনঃপ্রবর্তন করলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আরও সমুন্নত ও সংহত হবে এবং বিচার বিভাগের সার্বিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ হবে।
বিচার বিভাগের দ্বৈত শাসনের অবসান চাওয়া একদম ঠিক আছে বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ। তিনি বলেন, প্রধান বিচারপতি বিচার বিভাগের দ্বৈত শাসনের বিষয়টি তুলে ধরেছেন এবং বিচারবিভাগে যে সমস্যা আছে সেটা নিয়ে কথা বলেছেন। কিভাবে নিরসন করা যাবে তাও বলেছেন। তিনি বাস্তবতা তুলে ধরেই এটা বলেছেন। আমি তার কথার সঙ্গে একমত। ১৯৭২ সালের সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ বর্তমান বিধানের ওখানে ফিরিয়ে আনা দরকার। বর্তমানটি বাতিল করা দরকার।
তবে এ বিষয়ে একমত নন আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক। তিনি বলেন, প্রধান বিচারপতি তার কথা বলেছেন। এনিয়ে এখনো কোনো মন্তব্য করব না। বর্তমানে যেভাবে করা হয়েছে এটা নির্বাহী বিভাগ করলে ওতো তাদের মত নিয়েই করে।
এদিকে আইনমন্ত্রী দ্বৈত শাসন প্রসঙ্গ ও সংবিধানে ১১৬ অনুচ্ছেদ ফিরিয়ে আনার বিষয়টি নিয়ে এবং বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের নয় বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলবেন সোমবার বেলা ১২টায়।
সরকারের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলম বলেছেন, প্রধান বিচারপতি এ কথা বলেছেন তার উপলব্ধি থেকে। কিন্তু তিনি যে সমস্যার কথা বলেছেন সে সমস্যা আমরা ফিল করি না। কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমিতো নিম্ন আদালতে মামলা পরিচালনা করি না। এ কারণে ওই ভাবে বলতে পারব না। সংবিধানে ১১৬ অনুচ্ছেদ ফিরিয়ে আনার প্রয়োজন আছে কিনা এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রধান বিচারপতির কথার উপর এভাবে আমি বলতে পারি না। তিনি বলেন, অধস্তন আদালতে বিচারকদের বদলি, পদোন্নতি ও অন্যান্য বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃপক্ষ এককভাবে কাজ করতে পারে না। এটা আমি বুঝতে পারি না।
সাবেক আইনমন্ত্রী বলেন, ১৯৭২ সালের বিধানটি ফিরিয়ে আনা হলে কাজ করতে সুবিধা হবে।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন বলেন, উনি (প্রধান বিচারপতি) যেটা বলছেন সেটা উনার ভাবনা থেকে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বা আজকের যে অবস্থা সেটা মাজদার হোসেন মামলার রায়ের আলোকে। ওই রায়ের আলোকে অনেকগুলো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এখন আর মন্ত্রণালয় থেকে এককভাবে কোনো কিছু করা যায় না। একটা সময় হয়তো সেদিকে (সুপ্রিম কোর্টের একক ক্ষমতা) আর যাওয়ার প্রয়োজন হবে না। আর তারপরও প্রয়োজন হলে সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, প্রধান বিচাপরপতির এ বক্তব্যকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছি এবং এটিই হওয়া উচিত। বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দেওয়ার জন্য আমিও ৭২ সালের ১১৬ অনুচ্ছেদ পুনর্বহালের দাবি জানাচ্ছি।
উল্লেখ্য, ১৯৭৮ সালে ফরমানের মাধ্যমে ১১৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে বিচার বিভাগের নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রপতির হাতে নেওয়া হয়। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টে সামরিক শাসন জারির পর থেকে ৬ এপ্রিল ১৯৭৯ পর্যন্ত সামরিক শাসনামলের সব আদেশ, ঘোষণা ও দ-াদেশকে বৈধতা দেওয়া সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী পরে সর্বোচ্চ আদালতের আদেশে বাতিল হয়ে যায়। বিগত সরকার ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৭২ এর সংবিধানের চার মূলনীতি ফিরিয়ে আনলেও ১১৬ অনুচ্ছেদে ১৯৭২ এর বিধান আর ফিরিয়ে আনা হয়নি। বর্তমান সংবিধানে সংশোধিত ১১৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, বিচার-কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচারবিভাগীয় দায়িত্বপালনরত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি ও ছুটি মঞ্জুরিসহ) ও শৃঙ্খলাবিধান রাষ্ট্রপতির উপর ন্যস্ত থাকবে এবং সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তা প্রযুক্ত হবে। ১৯৭২ সালের সংবিধানে বিধান ছিল বিচার-কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচারবিভাগীয় দায়িত্বপালনেরত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি ও ছুটি মঞ্জুরিসহ) ও শৃঙ্খলাবিধান সুপ্রিম কোর্টের উপর ন্যস্ত থাকবে। সম্পাদনা: উম্মুল ওয়ারা সুইটি