ফেসবুকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সাম্প্রদায়িক হামলা…
ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করবে না
ডা. ইমরান এইচ সরকার, মুখপাত্র, গণজাগরণ মঞ্চ
নাসিরনগরে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস; হিন্দুদের শত শত ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ-ভাংচুর-লুটপাট, অন্তত ১৫টি মন্দির তছনছ, নৃশংস হামলায় শতাধিক হিন্দু নারী-পুরুষ রক্তাক্ত ও আহত! কয়েকদিন আগে পুজা নামের ৫ বছরের একটি অবুঝ শিশু ও আরেক গৃহবধূকে ধর্ষণ। এটা পরিষ্কার, বাংলাদেশ থেকে হিন্দু তাড়ানোর সকল আয়োজন সম্পন্ন। আর নির্বিকার সরকার ও প্রশাসন এই মাস্টারপ্ল্যানের সহযোগী। ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করবে না।
এই দেশ বহু জাতিগোষ্ঠীর
স্বকৃত নোমান, কথাসাহিত্যিক
এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি-ননবাঙালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব আপনাদের ওপর। আমাদের যেন বদনাম না হয়Ñ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধুর এই বাণীটি কি শুধুই যুদ্ধকালের জন্য প্রযোজ্য ছিল? নাকি চিরকালের জন্য? মনে তো হয় না বঙ্গবন্ধুপ্রেমীদের কাছে তার এই বাণীর কোনো গুরুত্ব আছে। ফেসবুকে ইসলাম অবমাননার অভিযোগ তুলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে অন্তত পাঁচটি মন্দির ভাঙা হয়েছে। ভাংচুর-লুটপাট হয়েছে হিন্দুদের শতাধিক ঘর। যে ছেলেটি ইসলামের ‘অবমাননা’ করেছে তাকে তো গ্রেফতার করা হয়েছে, আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে। আইন মোতাবেক তার বিচার হবে। কিন্তু তার একার অপরাধের জন্য এতগুলো বাড়ি-ঘরে, মন্দিরে হামলা কেন? আর ইসলাম তাহলে এতই ঠুনকো যে, কেউ কিছু বললেই তার অবমাননা হয়ে যায়?
এই দেশ শুধু মুসলমানের নয়। কখনো ছিল না। এই দেশ বহু জাতিগোষ্ঠীর। কতিপয় ধর্মোন্মাদ এই সত্যটি স্বীকার করতে চায় না। এই ধর্মোন্মাদের আইনের মুখোমুখি দাঁড় করাতে হবে। স্বীকার করতে যাতে বাধ্য হয়, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। তারা কা-জ্ঞানহীন। ডা-ার বাড়ি ছাড়া তাদের কা-জ্ঞান উদয় হয় না। ভবিষ্যতে যাতে আর কেউ এমন ঘটনা ঘটানোর সাহস না পায়, স্থানীয় প্রশাসনকে সেই পদক্ষেপ নিতে হবে এবং এই বহু জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে কিভাবে সম্প্রীতি বৃদ্ধি করা যায়, সরকারকে অবশ্যই সেই পদক্ষেপ নিতে হবে।
কোন ইসলাম আপনারা কায়েম করছেন?
আশীফ এন্তাজ রবি, সাংবাদিক ও সঞ্চালক
আমাদের অহংকারের, আমাদের বিজয়ের এই অসাধারণ সময়ে এই ঘটনা মানায় না। সারাবিশ্ব বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে আছে। যখন সিকিউরিটি নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে, তখন অনেক কষ্টে ইংল্যান্ডকে আমরা ঘরে নিয়ে আসলাম। পুরো বিশ্বকে দেখিয়ে দিলাম ৩টা জিনিস। এক. বাংলাদেশ নিরাপদ, দুই. বাংলাদেশ অতিথি পরায়ণ, তিন. বাংলাদেশ বিজয়ী। এই মধুর সমাপনী লগ্নে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনা আমাদের অনেকখানি পিছিয়ে দিলো। প্রতিমা ভেঙে আর প্রণামীর টাকা লুট করে যারা ইসলাম রক্ষা করতে নেমেছে, তাদের বলিÑ কোন ইসলাম আপনারা কায়েম করছেন? এটা ইসলামের শিক্ষা? আপনারা দেশকে অপমান করেছেন, ইসলামের অপমান করেছেন। যে ফেসবুকে কটাক্ষ করেছে, রাষ্ট্রের আইন তার বিচার করবে। সেজন্য লুটপাট আর ভাংচুর করতে হবে? ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সকল তরুণ এক হোন। আপনারা দেখিয়ে দিন, শান্তি এবং সম্প্রীতি কাকে বলে।
সাম্প্রদায়িক নিপীড়ন ইতিহাসের সকল সীমা অতিক্রম করেছে
ফিরোজ আহমেদ, কেন্দ্রীয় সদস্য, গণসংহতি আন্দোলন
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হিন্দু মন্দিরে আক্রমণ, ঘরবাড়ি-দোকানপাট লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগে নির্বিচারে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর পরিচালিত হয়েছে হামলা।
এই ধরনটি দেশে ইতোমধ্যেই বেশ পরিচিত। রীতিমতো ঘোষণা দিয়ে হামলা হবে। হামলাকারীদের ঠেকাতে প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেবে না। হামলা ঠেকাতে ব্যর্থ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো প্রশাসনিক ব্যবস্থাও নেওয়া হবে না। ক্ষমতাবলয়ে হামলাকারীদের গুরুত্ব বৃদ্ধি পাবে এবং প্রতিটা নাগরিকের জীবন, সম্পদ ও মর্যাদা রক্ষায় দায়িত্ব যার পালন করার কথা, সেই আওয়ামী লীগ সরকারের এই পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ মদদদাতার ভূমিকার কোনো সমালোচনায় যেতেও মোসাহেবগণ রাজি হবেন না। অক্ষম ক্রোধে কাল্পনিক শত্রুদের বিরুদ্ধে তারা অনেক বাকোয়াজি করবেন, কিন্তু প্রকাশ্যে যারা মদদ দিচ্ছে, তারা থাকবে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। আর কোনো মোসাহেবের মিষ্টি-মধুর ইনানো-বিনানো সরকার নিন্দা যদি দেখেন, ধরে নেবেন এই লেখাটা তিনি পড়েছেন। মোসাহেবরা ভুলুক, আপনি ভুলবেন না, ইতোমধ্যে এই সরকারের আমলে সাম্প্রদায়িক নিপীড়ন, দখল, হামলা ইতিহাসের সকল সীমা অতিক্রম করেছে।
রামুতে বৌদ্ধ মন্দিরে হামলার প্যাটার্নটাই চোখে পড়ে
কল্লোল মোস্তফা, গবেষক ও প্রকৌশলী
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দির ও ঘরবাড়িতে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাটি যেভাবে ঘটল, তাতে আজ থেকে ৪ বছর আগে রামুতে বৌদ্ধ মন্দিরে হামলার প্যাটার্নটাই চোখে পড়ে। টার্গেট সম্প্রদায়ের কোনো সদস্যের ফেসবুক একাউন্ট থেকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ। অভিযোগকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা সৃষ্টি। বিচারের দাবিতে সমাবেশ করে উত্তেজনা তুঙ্গে ওঠানো। একযোগে টার্গেট সম্প্রদায়ের মন্দিরে/ঘরবাড়িতে পাইকারি হামলা, লুটপাট।
বিডিনিউজ থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি:
‘রামু উপজেলার হাইটুপি গ্রামের বাসিন্দা উত্তম বড়ুয়ার ফেসবুক পেইজে কুরআন অবমাননা করে ছবি পোস্ট করেছেন এ অভিযোগ তুলে ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে ওই গ্রামে সংঘবদ্ধ হয়ে হামলা চালিয়ে লুটপাটসহ ১২টি বৌদ্ধ মন্দির ও ৩০টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে একদল লোক’।
বলে রাখি, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬ তারিখের এই নিউজের শিরোনাম ছিল: ‘রামুর সহিংসতার ৪ বছর: বিচার নিয়ে হতাশ ক্ষতিগ্রস্তরা’। অবশ্য একটা গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য হলোÑ আজ থেকে ৪ বছর আগে রামুতে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের উপর হামলাটি হয়েছিল গভীর রাতে আর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলা হয়েছে দিনে দুপুরে।
রামু হামলার বিচার হয়নি, এর আগে পরে আরও অনেক হামলা হয়েছে, সেগুলোরও বিচার হয়নি। আজ পরিস্থিতির এত উন্নতি হয়েছে, দিনে দুপুরেই কয়েক ঘণ্টা জুড়ে ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার কথিত অভিযোগে হিন্দু সম্প্রদায়ের বহু মন্দির ও ঘরবাড়িতে হামলা, লুটপাট, অগ্নি সংযোগ করা যায়।