আজ জেলহত্যা দিবস কারাগারে স্মৃতিচিহ্ন দেখতে হাজারো দর্শনার্থী
মাহমুদুল আলম : গতকাল দুপুর প্রায় বারটা। রাজধানীর নাজিমউদ্দিন রোডে পরিত্যাক্ত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে মানুষের ভীড়। কারারক্ষীরা ভীড় সামলাতে রীতিমত হিমশিম খাচ্ছেন। ২২৮ বছরের ইতিহাসে এটি নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হলেও পরিত্যাক্ত ঢাকা কারাগারের জন্য এটি স্বাভাবিক ঘটনা নয়। কার্তিকের এই ভর দুপুরে রোদে গাদাগাদি করে সারিতে দাঁড়িয়ে আছেন সবাই টিকিটের জন্য। ভিতরে চলছে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার ‘সংগ্রামী জীবন গাঁথা’ শিরোনামে প্রদর্শনী।
কারাগারে জাতীয় চারনেতার স্মৃতি জাদুঘরে আলাদাভাবে সংরক্ষণ করা আছে জাতীয় চারনেতার ব্যবহার্য আসবাবসহ অন্যান্য জিনিসপত্র। তবে চারনেতাকে যে কক্ষে হত্যা করা হয়, ওই ঘরের সামনে এসে থমকে যান দর্শনার্থীরা। কক্ষটিতে লোহার দন্ডে এখনো স্পস্ট ঘাতকদের বুলেটের ক্ষত। দর্শনার্থীদের বুঝার সুবিধার্থে সেখানে লেখা আছে ‘মৃত্যুঞ্জয়ী জাতীয় চার নেতার ঘাতকদের বুলেটের চিহ্ন।’
আজ জেলহত্যা দিবসকে সামনে রেখে গত মঙ্গলবার থেকে আগামি শনিবার পর্যন্ত টানা ৫ দিন কারাগারে চলছে এই প্রদর্শনী। তবে সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য প্রদর্শনী উন্মুক্ত হয়েছে গতকাল মঙ্গলবার থেকে।
দর্শনার্থীদের কেউ সেলফি তুলছেন ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ এসব স্মৃতিচিহ্নের পাশে, কেউ অন্য দর্শনার্থী বা দায়িত্বরত কারারক্ষীর সহযোগিতায় তুলছেন দলবদ্ধ ছবি। তবে এসবের মধ্যে সবাই নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছেন ইতিহাস নিয়ে।
বঙ্গবন্ধু কারা স্মৃতি জাদুঘরের সামনে অন্যান্য গাছের সঙ্গে আছে একটি করে সফেদা ও কামিনী গাছ। দুইটি গাছই লাগিয়েছেন বঙ্গবন্ধু নিজ হাতে। জাদুঘরে আছে কারাগারে বঙ্গবন্ধুর ব্যবহার করা আসবাবপত্র ও তৈজষপত্র।
রাজধানীর মহাখালী থেকে আসা বয়োজ্যেষ্ঠ দর্শনার্থী হাবিবুর রহমান(৭৭) প্রদর্শনী ঘুরে দেখে পরামর্শ দিয়ে বললেন, বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চারনেতার স্মৃতি প্রদর্শনের পাশাপাশি অন্যান্য ইতিহাসও যেন তুলে ধরা হয়। যাতে ২২৮ বছরের ইতিহাসই নতুন প্রজন্ম জানতে পারে।
প্রতিটি টিকিট বাবদ ১০০ টাকা করে নেয়া হচ্ছে। কারা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আয়োজক হিসেবে থাকা সংগঠন ‘জার্নি’ জানিয়েছে, প্রদর্শনী থেকে আসা টাকা, অপরাধ না করেও কারাগারে মায়ের সঙ্গে থাকা নাবালক শিশুদের খেলাধূলার সরঞ্জাম কেনা বাবদ খরচ করা হবে। সারাদেশে এমন শিশুর সংখ্যা ৩০০-৩৫০ হবে বলে জানায় তারা।
উল্লেখ্য ১৭৮৮ সালে একটি ক্রিমিনাল ওয়ার্ড চালুর মাধ্যমে এই কারাগারের যাত্রা শুরু হয়েছিল। দেশের সর্ববৃহৎ এই কারাগারটি গত ২৯ জুলাই স্থানান্তর হয়েছে কেরানীগঞ্জের রাজেন্দ্রপুরে। স্থানান্তরের পর গত ১ আগস্ট থেকে পুরান ঢাকার কারাগারটি পরিত্যক্ত হয়ে যায়। তবে সুদীর্ঘ যাত্রাপথে এ কারাগারের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে হাজারো স্মৃতি। দর্শনার্থীরা সেসব ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারবেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর জাতীয় চার নেতা- সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে বন্দি করে এই কারাগারে রাখা হয়। একই বছরের ৩ নভেম্বর রাতে এই কারাগারের ভেতরেই এই চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করা হয়। প্রতিবছর এই দিনটি ‘জেলহত্যা দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার রাজনৈতিক স্মৃতি বিজড়িত ১২৫টি আলোকচিত্র ও ভিডিও নিয়ে এই প্রদর্শনীর উদ্বোধন হয়।
১৭ একর জমির সদ্য পরিত্যক্ত এ কারাগারটির ভেতরে ঢুকলেই হাতের ডানে আছে শাপলা ও প্রতীকী মসজিদের একটি শৈল্পিক নিদর্শন। সামনে এগিয়ে বাম দিকে গেলেই দুটি ফাঁসিরমঞ্চ আর কয়েকটি ভবন। সড়কের একদম শেষ মাথায় জাতীয় চার নেতার ঐতিহাসিক সেল। এর পেছনেই রয়েছে তাদের স্মরণে তৈরি করা জাদুঘর। এর সীমানার ভেতরে রয়েছে চার নেতার আবক্ষ মূর্তি। হস্তান্তরের আগে চার নেতার মরদেহ যেখানে রাখা হয়েছিল সেই স্থানটিও চিহ্নিত করে রাখা হয়েছে।
জাদুঘর থেকে সোজা বের হলেই যমুনা ভবন ও যমুনা ভবন-২। যমুনা ভবন-২ এর ভেতর কারাগারের অভ্যন্তরীণ বিচার ও বৈঠকের কাজ চলতো। ভবনের ভেতরে নানা ধরনের কারুকার্য অঁাঁকা রয়েছে। এরপর কারাগারের সাধারণ কয়েদিদের ব্যবহারের জন্য নির্মিত টয়লেট। মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামিদের জন্য ৫টি কনডেম সেল। প্রতিটি সেলের ভেতরই রয়েছে অ্যাটাচড টয়লেট। দরজার পাশে বিশেষ তালা ঝুলানো থাকে কনডেম সেলগুলোতে। রয়েছে আসামিদের জন্য সেলুন। এটি বন্দিদের দ্বারা পরিচালিত হতো।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের স্মৃতি জাদুঘরের ভেতরে বঙ্গবন্ধুর মূর্তি ছাড়াও সামনে আছে ৬টি ছোট পিলার। এগুলোর প্রত্যেকটিতে একটি করে ৬ দফার দাবি লেখা রয়েছে।