মন্ত্রীর আপত্তিকর মন্তব্যের প্রতিবাদে আজ বিােভ-সমাবেশ ও মানববন্ধন ৫০ জনের একটি যুবক দল ছিল নাসিরনগরে মূল হামলায়
বিপ্লব বিশ্বাস: ব্রহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দু পরিবারগুলোর চোখ-মুখ থেকে আতঙ্কের ছাপ কাটছে না। সরকারি-বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তা ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা আশ্বাস দিচ্ছেন। প্রতিবেশীরা অভয় দেওয়ার চেষ্টা করছে, কিন্তু তাতে তিগ্রস্ত ব্যক্তিদের মন থেকে সেদিনের তা-বের ছাপ দূর হচ্ছে না। পুলিশ পাহারায় আছে, তবু চোখের পাতা এক করতে ভয় পাচ্ছে তারা, বিশেষ করে শিশুরা। চোখ বন্ধ করলেই ভেসে উঠছে মন্দির ও বাড়িঘরে হামলার দৃশ্য, আঁতকে উঠছে তারা।
এদিকে, দেশের একটি শীর্ষ স্থানীয় গোয়েন্দা সংস্থা জানতে পেরেছে, ফেসবুকে ইসলাম অবমাননার পোস্ট দিয়ে পূর্বপরিকল্পিতভাবে হামলার ঘটনায় জড়িত উগ্রবাদী তিনটি ইসলামিক রজনৈতিক সংগঠন। আর এদের উৎসাহ জুগিয়েছে আওয়ামী লীগের বিবদমান কোন্দল। আওয়ামী লীগের একটি গ্রুপ এ ঘটনার উস্কানি দিয়েছে। ইতোমধ্যে তাদের একটি রিপোর্ট ঊধ্বতন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন। অন্যদিকে, আক্রান্ত হওয়ার ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কোনো সংসদ সদস্য এবং মন্ত্রীকে দুর্গতদের পাশে দাঁড়াতে না দেখায় সরকারের নীতিনির্ধারক মহলে ক্ষোভের সঞ্চয় হয়। পাশপাশি অভিযোগ তুলেছে,প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা ও রাজনৈতিক দলের নেতাদের নীরব থাকার কারণে সংখ্যালঘু হিন্দুরা মার খেয়েছে।
এদিকে,ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে দুর্বৃত্তদের হামলা নিয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী মো. ছায়েদুল হকের আপত্তিকর মন্তব্যের প্রতিবাদে আজ ও আগামীকাল সারাদেশে বিােভ-সমাবেশ ও মানববন্ধনের ডাক দিয়েছে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ এবং বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ।
জানা যায়, স্থানীয় সংসদ সদস্য (মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী) অ্যাডভোকেট ছায়েদুল হক ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর আসনের সংসদ সদস্য র আ ম উবায়দুল মোক্তাদির চৌধুরীর দ্বন্দ্ব। হামলার ৭২ ঘণ্টা পর হরিপুর এলাকা পরিদর্শনে যান সদর আসনের এমপি। একটি সূত্র জানায়, হরিপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান দেওয়ান আতিকুর রহমান আঁখি সদরের এমপির বিশ্বস্ত লোক। গত ইউপি নির্বাচনে তাকে চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন দেওয়া নিয়ে দুই এমপির মধ্যে দ্বন্দ্ব বাঁধে। হামলায় মতাসীন দল আওয়ামী লীগের স্থানীয় লোকজনও জড়িত থাকার অভিযোগ উঠায় উভয় এমপির অনুসারীদের মধ্যে বিভক্তি আরও দৃশ্যমান হয়েছে। স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের ডাকবাংলোতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-প্রশাসনের সামনেই প্রাণিসম্পদমন্ত্রী মো. ছায়েদুল হক গালি দেন এবং বলেন ‘মালাউনের বাচ্চারা বিষয়টি নিয়ে বাড়াবাড়ি করছে।
স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া আওয়ামী লীগের কোন্দলের কারণে সুযোগ সন্ধানী হেফাজতে ইসলাম ও তাদের ব্যানারে জামায়াত শিবির ও সুন্নাত ওয়াল জামাত,এই সহিংসতা ঘটিয়েছে। ঘটনার উগ্রতা নিরসনে স্থানীয় প্রশাসনের ঢিলেমি রয়েছে। ঘটনাটি থামানোর জন্য স্থানীয় রাজনীতিবিদরা তেমন একটা ভূমিকা রাখেননি। শুধু এলাকার স্থানীয় স্থায়ী কিছু মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ ঘটনাটি প্রতিহত করতে এগিয়ে এসেছিলেন। এতে নাসিরনগর সদরের প্রায় ৩৫জন স্থানীয় মুসলমান আহত হয়েছেন। নাসিরনগরের সংখ্যালঘু নেতারা বলেছেন, ঘটনার আগের দিন এলাকায় মাইকিং করে পরদিন হামলা করা হয়। ঘটনাটি নাসিরনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও থানার ওসিকে জানানো হয়েছিল। কিন্তু তারা সময়মতো ব্যবস্থা নেননি। এর ফলে সহিংসতা বেশি হয়েছে।
সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে অনেকেই বলছে, হামলা-ভাঙচুরে একাধিক টিম জড়িত ছিল। দেখে মনে হয়েছে পরিকল্পনা করেই এসেছিল তারা। ২০ থেকে ৩০ বছর বয়সী যুবকদের একটি দল ছিল মূল হামলায়। এ দলে ছিল প্রায় ৫০ জন। কাছাকাছি অবস্থান করে কয়েকশ লোক এ টিমকে সমর্থন জুগিয়েছে। হামলার পর দুই গ্রুপ মিলে নিরাপদে সরে পড়ে। প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধরে তা-ব চললেও প্রশাসনের ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। তবে হামলার সময় স্থানীয়দের কেউ কেউ তা প্রতিরোধেও এগিয়ে আসে।
স্থানীয় লোকজন ও প্রত্যদর্শীরা বলছে, একদল হামলা চালায়, আরেক দল ব্যস্ত ছিল লুটপাটে। এলাকার জমিদারবাড়ি হিসেবে পরিচিত দত্তবাড়িতে হামলার চেয়ে লুটপাটের চেষ্টাই বেশি হয়েছে। বড় আকারের কাঠের সদর দরজা ভেঙে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করে হামলাকারীরা। ঘটনার সময় উপস্থিত সুমন নামের স্থানীয় এক যুবক তাদের বাধা দিতে গিয়ে আহত হয়।
অভিযোগ রয়েছে, রবিবারের ওই হামলায় মূল ভূমিকা পালন করে খাঁটি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত নামের একটি সংগঠন। হামলার সময় তাদের একটি সমাবেশ চলছিল। স্থানীয়দের অভিযোগ, ওই সবাবেশ থেকে একাধিক গ্রুপে ভাগ হয়ে হামলা করে সংঘবদ্ধ কিছু যুবক। হামলার ধরন ও তাদের পোশাক দেখে প্রত্যদর্শীরা দাবি করেছে, হামলায় অংশ নেওয়া প্রত্যেকে প্রশিতি। হামলার ব্যাপারে তাদের দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা ও ছক ছিল। হামলায় মূলত অপরিচিত যুবকদের ব্যবহার করা হয়েছে। প্রত্যদর্শী জানান, দাঁতমন্ডল গ্রামের তাজউদ্দিনের ছেলে মাহবুব হামলায় অংশ নিয়েছেন। কুলিকুন্ডা গ্রামের বিল্লাল আলীর ছেলেকেও নেতৃত্ব দিতে দেখা যায়। আশপাশের ২৬টি গ্রাম থেকে হামলাকারীরা এলেও হরিপুর গ্রাম থেকে এক হাজার লোক আসে। এ ছাড়া উপজেলা কমপ্লেক্স মসজিদের পেশ ইমাম মোখলেছুর রহমান ও চাপরতলা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. সুরুজ আলী মিছিল নিয়ে এসে আহলে সুন্নাতের সমাবেশে যোগ দেন। তারা দুজন মাইকে উপস্থিত লোকজনকে নানা ধরনের বক্তব্যের মাধ্যমে উসকে দিতে থাকেন। স্থানীয়দের অভিযোগ, হামলার মূল নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে তাদের উস্কানি। তবে উভয়ই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। সম্পাদনা: বিশ্বজিৎ দত্ত