১৯৭২-এর ১১৬ অনুচ্ছেদ ফেরানো প্রশ্নে সিদ্ধান্ত আসতে পারে আদালত থেকে
নাশরাত আর্শিয়ানা চৌধুরী: ১৯৭২ সালের সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ ফিরিয়ে আনার পক্ষে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। কিন্তু এখনই তা করতে রাজি নন আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক। এনিয়ে দুইজনের স্পষ্ট অবস্থান ফুটে উঠেছে। তবে একজন আইনজীবী এই ব্যাপারে একটি সমাধান আসার জন্য আদালতে রিট করেছেন। আবেদনটির শুনানি হতে পারে রোববার।
সংবিধানের ষষ্ঠ ভাগে বিচারবিভাগে ১ম পরিচ্ছেদে সুপ্রিমকোর্ট বিচারক-নিয়োগ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ৯৫। (১) প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হইবেন এবং প্রধান বিচারপতির সহিত পরামর্শ করিয়া রাষ্ট্রপতি অন্যান্য বিচারককে নিয়োগদান করিবেন। (২) কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশের নাগরিক না হইলে, এবং (ক) সুপ্রিমকোর্টে অন্যূন দশ বৎসরকাল অ্যাডভোকেট না থাকিয়া থাকিলে; অথবা (খ) বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে অন্যূন্য দশ বৎসর কোনো বিচার বিভাগীয় পদে অধিষ্ঠান না করিয়া থাকিলে; অথবা (গ) সুপ্রিমকোর্টের বিচারক পদে নিয়োগলাভের জন্য আইনের দ্বারা নির্ধারিত যোগ্যতা না থাকিয়া থাকিলে; তিনি বিচারকপদে নিয়োগ লাভের যোগ্য হইবেন না।
(৩) এই অনুচ্ছেদে ‘‘সুপ্রিমকোর্ট’’ বলিতে এই সংবিধান প্রবর্তনের পূর্বে যেকোনো সময়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে যে আদালত হাইকোর্ট হিসাবে এখতিয়ার প্রয়োগ করিয়াছে, সেই আদালত অন্তর্ভুক্ত হইবে।
ষষ্ঠ ভাগ, বিচারবিভাগ, ২য় পরিচ্ছেদ, অধঃস্তন আদালত, অধঃস্তন আদালতসমূহের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা প্রসঙ্গে সংবিধানের ১১৬-তে বিস্তারিত বলা আছে। তাতে বলা হয়েছে, ১১৬। বিচার-কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচারবিভাগীয় দায়িত্বপালনে রত ম্যাজিষ্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল- নির্ধারণ, পদোন্নতিদান ও ছুটি মঞ্জুরিসহ) ও শৃঙ্খলাবিধান রাষ্ট্রপতির উপর ন্যস্ত থাকিবে এবং সুপ্রিমকোর্টের সহিত পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তাহা প্রযুক্ত হইবে।
বিচারবিভাগীয় কর্মচারীগণ বিচারকার্য পালনের েেত্র স্বাধীন-এর ব্যাপারে বলা হয়েছে, ১১৬ক। এই সংবিধানের বিধানাবলী সাপেে বিচার-কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিগণ এবং ম্যাজিষ্ট্রেগণ বিচারকার্য পালনের েেত্র স্বাধীন থাকিবেন।
১৯৭২ সালের সংবিধানে বিধান ছিলো বিচার-কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচারবিভাগীয় দায়িত্বপালনেরত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি ও ছুটি মঞ্জুরিসহ) ও শৃঙ্খলাবিধান সুপ্রিমকোর্টের ওপর ন্যস্ত থাকবে।
সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, ১৯৭২ সালের ১১৬ এর বিধানটি ফিরিয়ে আনা হলে কাজ করতে সুবিধা হবে। প্রধান বিচারপতি কাজ করছেন। তিনি বাস্তবতা বিবেচনা করছেন। আর আমার মনে হয় সরকারের এই বিষয়টি আমলে নিয়ে এই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সম্পূর্ণভাবেই থাকা দরকার। এখন যে বিধান আছে তাদের প্রধান বিচারপতির ভাষায় যে দ্বৈত শাসনের বিষয়টি এসেছে। আমিও তাই মনে করি। এই কারণে এটার পরিবর্তন দরকার।
এদিকে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ইউনূস আলী আকন্দ বিচারক নিয়োগ সংক্রান্ত সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদ ও অধঃস্তন আদালতের বিচারকদের বদলি, পদোন্নতি সংক্রান্ত সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট আবেদন করেছেন। আবার অনুচ্ছেদ দুটিকে সংবিধানের ৩০ ও ৩৯ অনুচ্ছেদের সঙ্গে কেন সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হবে না এই মর্মে রিটে রুল চেয়েছেন। সেখানে আইনসচিব, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, সুপ্রিমকোর্টের রেজিস্ট্রারসহ চারজনকে বিবাদী করা হয়। রোববার রিট আবেদনটি শুনানির জন্য আদালতে উপস্থাপন করা হবে।
সম্প্রতি প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেন, সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ বিচার বিভাগের ধীরগতির অন্যতম কারণ। উল্লেখিত প্রোপটে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে¡ প্রণীত ১৯৭২ সালের সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদটি পুনঃপ্রবর্তন হওয়া সময়ের দাবি। প্রধান বিচারপতির মতে, সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদে অধঃস্তন সকল আদালত ও ট্রাইব্যুনালের ওপর হাইকোর্টের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ থাকবে বলা হয়েছে। কিন্তু ১১৬ অনুচ্ছেদে যে বিধান দেওয়া হয়েছে তা বিচার বিভাগের ধীরগতির অন্যতম কারণ। এই অনুচ্ছেদ অনুসারে অধঃস্তন আদালতের বিচারকদের পদোন্নতি, বদলি এবং শৃঙ্খলামূলক কার্যক্রম সুপ্রিমকোর্টের পে এককভাবে গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না। দ্বৈত শাসনের ফলে বহু জেলায় শূন্য পদে সময়মত বিচারক নিয়োগ প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে বিচার কাজে বিঘœ ঘটে এবং বিচারপ্রার্থী জনগণের ভোগান্তি বেড়ে যায়। এই প্রোপটে ১৯৭২ সালের সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদটি পুনঃপ্রবর্তন করা সময়ের দাবি। আগের বিধানে বলা আছে, বিচার-কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচার বিভাগীয় দায়িত্বপালনরত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল, পদোন্নতি, ছুটি মঞ্জুরিসহ) ও শৃঙ্খলাবিধান সুপ্রিমকোর্টের উপর ন্যস্ত থাকবে। উক্ত বিধানটি পুনঃপ্রবর্তন করলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আরও সমুন্নত ও সংহত হবে এবং বিচার বিভাগের সার্বিক অগ্রগতির েেত্র নতুন মাত্রা যোগ হবে।
সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ প্রধান বিচারপতি বিচার বিভাগের দ্বৈত শাসন ও যে সমস্যার কথা বলেছেন পাশাপাশি এটাকে কিভাবে নিরসন করা যাবে তাও বলেছেন। আমি মনে করি ১৯৭২ সালের সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ বর্তমান বিধানের ওখানে ফিরিয়ে আনা দরকার।
উল্লেখ্য, ১৯৭৮ সালে ফরমানের মাধ্যমে ১১৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে বিচার বিভাগের নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রপতির হাতে নেওয়া হয়। ১৯৭৫ এর ১৫ অগাস্টে সামরিক শাসন জারির পর থেকে ৬ এপ্রিল ১৯৭৯ পর্যন্ত সামরিক শাসনামলের সব আদেশ, ঘোষণা ও দ-াদেশকে বৈধতা দেয়া সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী পরে সর্বোচ্চ আদালতের আদেশে বাতিল হয়ে যায়। বিগত সরকার ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৭২ এর সংবিধানের চার মূলনীতি ফিরিয়ে আনলেও ১১৬ অনুচ্ছেদে ১৯৭২ এর বিধান আর ফিরিয়ে আনা হয়নি। সম্পাদনা: সুমন ইসলাম