জঙ্গি তাহরিমের জবানবন্দীতে গুলশান আজিমপুর কল্যাণপুর নারায়ণগঞ্জ ও রূপনগর প্রসঙ্গ
আজাদ হোসেন সুমন: আজিপুরের জঙ্গি আস্তানা থেকে গ্রেফতার তানভীর কাদেরীর কিশোর ছেলে তাহরিম কাদেরীর সম্প্রতি আদালতে দেয়া জবানবন্দীতে গুলশান হামলা, নারয়ণগঞ্জর, কল্যাণপুরের, রুপনগরের পুলিশের অপারেশনসহ জঙ্গি নেটওয়ার্কের চিত্র ফুটে উঠেছে। গুলশান হামলার আগের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে তাহরিম জানান, চকলেট ও র্যাশের কথামতো গত রমজান মাসে তার বাবা বারিধারায় একটি বাসা নেন। ওই বাসায় ওঠার পর চকলেট প্রথমে দুইজন এবং পরে তিনজনকে ওই বাসায় নিয়ে যায়। ওই পাঁচজনের সাংগঠনিক নাম সাদ, মামুন, উমর, আলিফ ও শুভ। কয়েক দিন পর ওই বাসায় তামিম ও মারজান যান। একই দিন জাহাঙ্গীর তার স্ত্রী ও ছেলে শুভকে নিয়ে যায়। একই সঙ্গে হৃদয় নামে আরেকজনকে নিয়ে যায় চকলেট।
তাহরিম বলেন, তামিম, মারজান ও চকলেট তাদের বাসায় ব্যাগে ভরে অস্ত্র নিয়ে আসেন। তামিম, সাদ, মামুন, উমর, আলিফ ও শুভ একই সঙ্গে তাহরিমদের বাসায় থাকতেন। ঘরের দরজা বন্ধ করে তারা কথা বলতেন। আলিফ ও উমর (উজ্জ্বল ও পায়েল) অনেক ‘অপারেশন’ করেছেন বলে গল্প করতেন। কুষ্টিয়ায় একজন খ্রিস্টান বা হিন্দুকে মেরে রক্তমাখা প্যান্ট খুলে পালিয়ে আসেন বলেও গল্প করেন। তারা জিহাদ ও প্রশিক্ষণ নেওয়ার কথা বলে।
তাহরিম আদালতে বলেন, ‘আংকেলরা বলতেন, তারা একটি বড় অপারেশন করবেন। তবে কী ঘটবে তা গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলার ঘটনার আগে জানতাম না।’ ঘটনার দিনের বর্ণনা করে তাহরিম জানান, বিকাল ৫টার দিকে সাদ, মামুন, উমর, আসিফ ও শুভ কাঁধে একটি ব্যাগ নিয়ে বের হওয়ার সময় সবার সঙ্গে কোলাকুলি করেন। এর দুই-এক দিন আগে জাহাঙ্গীর, তার পরিবার ও হৃদয় বাসা থেকে চলে যান। পাঁচজন বের হওয়ার পর তামিম আর চকলেটও বের হন। এ সময় চকলেট তাহরিমের আব্বুকে বলেন, তোমরা যত তাড়াতাড়ি পার বাসা ছেড়ে চলে যাও। কথামতো ইফতারের পর ব্যাগ নিয়ে ট্যাক্সিক্যাবে করে পল্লবীর বাসায় যান সবাই। এরপর তারা অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও টেলিভিশনে গুলশানে হলি আর্টিজানে গোলাগুলির খবর পান।
গণমাধ্যমে ছবি প্রকাশিত হলে তাহরিম তাদের বাসায় অবস্থানকারীদের প্রকৃত নাম জানতে পারেন। তাহরিম জানান, গুলশান হামলার কয়েক দিন পর র্যাশ তাদের জানান, চকলেটকে পাওয়া যাচ্ছে না। তখন সে বাসা পরিবর্তন করতে বলেন। তখন রূপনগরে বাসা ভাড়া নেন তাহরিমের বাবা। পরবর্তী নির্দেশনা অনুযায়ী গত ১ আগস্ট তাহরিমরা আজিমপুরের বাসায় যায়। মারজানের স্ত্রী ও চকলেটের স্ত্রীও সেখানে চলে যান। নারায়ণগঞ্জের জঙ্গি আস্তানায় অভিযানে তামিমসহ তিনজন নিহত হওয়ার পর মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলাম ব্যাগসহ তাদের আজিমপুরের বাসায় যান। তখন তিনি জানিয়েছিলেন, নারায়ণগঞ্জ থেকে একজন পালিয়েছে। সেই পুলিশকে তথ্য দিয়েছিল। ওইদিন থেকে জাহিদ ও তার মেয়ে পিংকি আজিমপুরের ওই বাসায় থাকতেন। একদিন সন্ধ্যার আগে জাহিদ রূপনগরের বাসায় যায়। সেদিনই পুলিশের অভিযানে সে মারা যায়। অভিযানে আটক হওয়ার ঘটনা বর্ণনা করে তাহরিম বলেন, ১০ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে কেউ তাদের বাসার দরজায় কড়া নাড়ে। এ সময় তাহরিম ডোরভিউ দিয়ে দেখে অনেক লোক। তখন সে তার বাবা-মাকে জানালে তারাও দেখেন। তানভীর কাদরী তার স্ত্রীকে একটি পিস্তল ও বটি দেন। তিনি দরজার ওপ্রান্তের লোকজনের পরিচয় জানতে চাইলে অপর প্রান্ত থেকে পুলিশ বলে জানানো হয়। এ সময় তানভীর কাদরী পুলিশের পরিচয়পত্র দেখতে চান। পুলিশ দরজার অপর প্রান্ত থেকেই পরিচয়পত্র দেখায়। তখন তানভীর দরজা খুলে দেন। এ সময় পুলিশ তাকে প্রশ্ন করে, ‘দরজা খুলতে দেরি হলো কেন? আপনাদের পরিবারের সবাইকে দেখতে চাই ডাকেন।’ পুলিশ নাম জানতে চাইলে তাহরিম বলেন তার নাম রাসেল। তানভীর বলেন তার নাম জমশেদ। এ সময় তানভীর ডান পাশের কক্ষে ঢোকার চেষ্টা করলে পুলিশ তাকে ধরে ফেলে। তাহরিম পুলিশকে ধাক্কা দিলে তিন পুলিশ তাকে ধরে পাশের কক্ষে নিয়ে যায়। তখন তানভীর পাশের কক্ষে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেন। পুলিশ বলেন, ‘এদের কাছে অস্ত্র আছে।’
ওই ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে তাহরিম বলেন, ‘পুলিশ দরজা ভেঙে বের হওয়ার চেষ্টা করলে আব্বু বঁটি নিয়ে এদিক-ওদিক ঘুরাতে থাকেন। তখন পুলিশ আমাকে সামনে ধরে। আমি বলি, আব্বু আমার শরীরে লাগবে। তখন আব্বু বলে, লাগলে হয় শহীদ হবা, না হলে আল্লাহ তোমাকে উত্তম প্রতিদান দিবেন। তারপর একজন পুলিশ আমাকে বারান্দায় নিয়ে যায়। এর মধ্যে আন্টিরা মরিচের গুঁড়া ছিটিয়ে দেন। পুলিশ তোষক দিয়ে আত্মরক্ষা করার চেষ্টা করে।’
তাহরিম বলেন, ‘এরপর আরও পুলিশ এসে আমাকে এবং আমার সঙ্গে থাকা পুলিশ সদস্যদের উদ্ধার করে। এর আগে প্রিয়তী আন্টি চাকু দিয়ে একজন পুলিশ সদস্যকে আঘাত করেন এবং আমি চাকু দিয়ে একজনকে আঘাত করি। অনেক গোলাগুলি হয়। পুলিশ সদস্যরা আমাদের ও আহত পুলিশ সদস্যদের উদ্ধার করে নিয়ে আসার সময় দেখি আব্বুর গলাকাটা এবং প্রিয়তী আন্টির গায়ে রক্ত। আম্মুকে দেখি রক্তাক্ত অবস্থায় নড়াচড়া করছেন। আব্বু সম্ভবত সুইসাইড করেছেন। আব্বু আমাকে বলতেন, যদি কখনো ধরা পড়ি তখন সুইসাইড করব। পুলিশ আমাদের বাসা থেকে চারটি পিস্তল, গুলিসহ অন্যান্য জিনিসপত্র উদ্ধার করে।’ ভাইয়ের ব্যাপারে তাহরিম বলেন, ‘আমার ভাই আদরকে আব্বু রূপনগরের বাসা থেকে অন্যত্র পাঠিয়ে দেন। তবে কোথায় পাঠিয়েছেন জানি না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের কে পদস্থ কর্মকর্তা বলেছেন, জবানবন্দী শেষে তাহরিম কাদেরীকে কিশোর সংশোধানাগারে পাঠানো হয়েছে-কিশোর অপরাধ আইনে তার বিচার হবে। সম্পাদনা: সুমন ইসলাম