ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সহিংসতা : কার দায় কতটুকু?
রবিউল আলম
মালাউন শব্দের অর্থ ভালো বুঝি না, কিন্তু মানুষ শব্দের অর্থ আমি বুঝি। মানুষ আর মানবতা কি তা বুঝি বলেই সাধারণ জনতার দল, মানবতার পক্ষের দল আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছি। বেছে নিয়েছি মানবসেবা করার বড় জায়গা রাজনীতি। মানুষের জন্য কিছু করতে পারলেই তো জীবন স্বার্থক। কে হিন্দু, কে মুসলিমÑ এভাবে কখনো বিচার করিনি কাউকে। জন্মেছি আসামের নওগাঁ গ্রামে। ১৯৬৩ সালে এদেশে আসা, বাপ-দাদার জন্মভূমি বিক্রমপুর। শৈশব থেকেই রায়ের বাজার এলাকায় বসবাস করছি। যখন সেখানে বসবাস শুরু করি তখন রায়ের বাজারে বড় জোর ১০টি মুসলিম পরিবার ছিল। মিরপুর বড় বাজার থেকে শনি ও মঙ্গলবার রায়ের বাজার আসতাম হাট করতে। বাবার সঙ্গে আশুলিয়া, টঙ্গী, সাভারসহ বিভিন্ন হাটে যেতাম ব্যবসার কাজে।
একদিন রায়ের বাজারে এসেছি কাঁচামাল বিক্রি করতে। কিন্তু মাল আর বিক্রি করতে পারিনি। বাবা হতাশ, বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু তা আমাকে বুঝতে দিচ্ছিলেন না বাবা। আকড়া মন্দিরের পাশে বাবার সঙ্গে বসে আছি, অপেক্ষা করছি যদি বিক্রি হয়। কিন্তু কার কাছে বিক্রি করব, মানুষ কোথায়? তখন রাত বাজে নয়টা, ঘোর অন্ধকার। একটু একটু ভয়ও লাগছে, কোথাও মানুষের শব্দটিও নেই! এমন সময়ে হারিকেন হাতে পল্লাত পাল মন্দিরের ঠাকুর পরিদর্শনে আসেন। ঠাকুর পরিদর্শন করে আমাদেরকে দেখতে পেয়ে দাঁড়ালেন। কি যেন দেখলেন। বাবাকে জিজ্ঞেস করলেন, এখানে বসে আছেন কেন দাদা? এতটুকু বাচ্চা একটা ছেলে সঙ্গে, তাকে নিয়ে এভাবে কতক্ষণ বসে থাকবেন। আমার বাড়ি চলুন, আপনাদের মালের কিছু হবে না। ভয় পাবেন, চলুন আমার সঙ্গে। আমরা বাপ-বেটা পল্লাত পালের বাড়ি যাই সেই রাতে। মুড়ি, চিড়া ও মিঠাই দিয়ে রাতের খাবার নিশ্চিত করি। সেই থেকে রায়ের বাজারের বাসিন্দা। আজও সেই আকড়া মন্দিরের পাশে বসবাস করছি। সেদিন যদি পল্লাত পাল আমাদের মুসলিম বলে বিপদে পাশে না থাকত, আমাদের অনাচার করত তাহলে কি আমার মনে আজ মানবিকতা, মানুষের কথা আসত। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরবাসীর কাছে বিষয়টি কেমন লাগবে জানি না, তবে আমার মনে সেই শৈশব থেকেই হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান আলাদা করে দেখা হয়নি এ সমাজে। আমরা দেখিনি। দেখেছি মানুষে মানুষে সম্প্রীতির বন্ধন। যার যার ধর্ম সে পালন করেছে। মিলেমিশে থেকেছি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধও তো অনাচার, অন্যায়, অসমতা, বৈষম্য, হিংসা-বিদ্বেষ, অপকর্মের বিরুদ্ধে ছিল। অসম্প্রদায়িক বাংলাদেশই তো ছিল আমাদের লক্ষ্য। যে লক্ষ্য অর্জনে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খিস্টান সব শ্রেণি-পেশার মানুষেরই তো অংশগ্রহণ ছিল। দেশ মাতৃকাকে শত্রুমুক্ত করতে কাঁধে কাঁধ রেখে লড়াই করেছে। জয়ী হয়েছি আমরা।
এই তো সেদিনের কথা, মহাউৎসব দুর্গাপূজা হয়ে গেল। প্রতিবারের ন্যায় এবারও হিন্দু ভাইদের পাশে থেকে পূজাকে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে সহযোগিতা করেছি। শান্তি প্রতিষ্ঠা, শান্তি রক্ষা করা দেশের উন্নয়নের প্রথম শর্ত। পৃথিবীর কোন দেশ, দেশের মানুষ কীভাবে চলে, কার সঙ্গে কি আচরণ করে তা দিয়ে আমাদের পরিবেশ নষ্ট করব কেন? বিধাতা পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন মানুষের জন্য, ধর্ম দিয়েছে শান্তির জন্য। সব সৃষ্টির মালিক যদি মহান আল্লাহকে মানেন তবে হিন্দু-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ সৃষ্টি করেছেন কে?
আমরা মুসলিমরা বিশ্বাস করি, সকল সৃষ্টির মালিক মহান আল্লাহ। আল্লাহই তো বলেছেন, কোনো ধর্মকে আঘাত না করতে, মানুষের প্রতি অনাচার না করতে, সৃষ্টির প্রতি সদয় থাকতে, মানবিক হতে। নাসিরনগরের মুসলমানদের কাছে কি আল্লাহ্্র প্রকৃত বাণীসমূহ পৌঁছায়নি? যারা হিন্দুদের মন্দির ও ঘর-বাড়িতে আগুন দিল, সহিংসতা চালাল, নিরীহ নিরস্ত্র মানুষের উপর অত্যাচার করল, কেন? অপরাধ কি ছিল তাদের? হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ, তাই অপরাধ? যদি সৃষ্টিকর্তাকে মানেন তবে মানবসেবা করুন, মানুষের সেবা করুন। আল্লাহ শুধু মুসলিমদের সেবা করতে বলেননি, তার সৃষ্টির সেবা করতে বলেছেন। তার সকল সৃষ্টি সমূহকে ভালোবাসতে, রক্ষা করতে বলেছেন। সত্যিই যদি সকল সৃষ্টির মালিক আল্লাহ বিশ্বাস করেন তাহলে নাসিরনগরে শান্তিপ্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসুন। ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ান। অসম্প্রদায়িক বাংলাদেশের ঐতিহ্যকে রক্ষা করুন।
লেখক: মহাসচিব, বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতি
সম্পাদনা: আশিক রহমান