নিবিড় ঘন আঁধারে জ্বলিছে ধ্রুবতারা
অজয় দাশগুপ্ত
একেক সময় মনে হয় আর বুঝি পথ নেই। মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত স্বদেশটি এবার আবার পড়েছে পুরনো সাম্প্রদায়িক ভূতের কবলে। সাতচল্লিশের ভূত একাত্তরে তাড়ালেও স্বাধীনতার পরপরই আবার ফিরে আসে। সম্প্রতি নাসিরনগরের ঘটনায় বুঝিয়ে দিয়েছে, অপসারিত হলেও সে মরেনি। দেশ শাসনে আওয়ামী লীগ। এদেশের চেতনা ও মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বের দাবিদার। যুদ্ধের সময় তারাই ছিল একক শক্তি। কিন্তু এখন আর সে বাস্তবতা নেই রাজনীতিতে। তারা যখনই শাসনভার নেয়, কোনো না কোনো কারণে হিন্দুরা মার খায়। এমনকি ভোট এলেও তাদের জন্য মার খাওয়াটা সংখ্যালঘুরা নিয়তি বলে মেনে নিয়েছে। কিন্তু যাদের হাতে প্রশাসন, যাদের হাতে গোয়েন্দা বাহিনী, যাদের আঁচে তৃণমূল বিস্তৃত দলের শাখা-প্রশাখা তারা কেন এ ধরনের ঘটনা ঘটার আগে বা পরে তা সামাল দিতে পারে না? জানি তারা মানবেন না। তবে এটাই সত্য, তাদের ভিতরেও ঘাপটি মেরে আছে সাম্প্রদায়িকতা। তাদের দলের এমন হাজার হাজার নেতা-কর্মী আছে যারা দল করে কিন্তু সাম্প্রদায়িক। নানা কারণে এই বিদ্বেষ। কারও ইচ্ছে জমি দখল, কারও নারী নির্যাতন, কারও আছে ধর্মীয় উন্মাদনা। সব মিলিয়ে এখন এমন এক পরিবেশ ঘটনা ঘটবে। মার খাবে, মূর্তি ভাঙবে। তারপর মিডিয়া ও সচেতনতা বলতে বলতে মানুষকে ক্লান্ত করে স্বীকার করাবে এদেশ এখনো অসাম্প্রদায়িক। নিবীর্য প্রায় হিন্দুদের মূল সমস্যা, তাদের প্রতিরোধহীন মনোভাব। যার আরেকটা বড় কারণ বাড়ির কাছের প্রতিবেশী দেশ। পলায়নের ভিতর দিয়ে নিজ দেশের প্রগতিশীল ও স্বীয় জনগোষ্ঠীকে দুর্বল করে চলে যাওয়াই আজ এই পরিবেশ তৈরি করেছে। হিন্দুরা আনন্দ উৎসবে যতটা পারঙ্গম, ততটা পিছিবে প্রতিরোধে। এবার দেখলাম, নাসিরনগরের ঘটনার পর নেপালে প্রতিবাদ হয়েছে। প্রতিবাদ হয়েছে ভারতে ও বিদেশের নানা জায়গায়। বিষয়টা এখন এমন দেশ বা সরকারকে জাগাতে চাই বিদেশের প্রতিবাদ। যেটা আমরা চাই না। অথচ ভাবমূর্তির প্রশ্নে সংবেদনশীল এই সরকার মূর্তিই নিরাপদ রাখতে পারছে না।
তবে এর পরিণাম কী? এদেশ কি হিন্দু শূন্য হয়ে যাবে? না তারা থাকতে পারবে না এদেশে? আমার মনে হয় না, এমন কিছু হবে কোনোদিন। এখন অবদি দেশের চারদিকে জ্বলে ওঠা প্রতিবাদের আগুন আর মানুষের নেমে আসা প্রমাণ করেছে মানুষ এসব চায় না।
আমি ব্যক্তিগতভাবে জানি, বাঙালি মুসলমানের বিশাল এক অংশ আমাদের বন্ধু, আমাদের স্বজন। এরা নিজেদের কারণে, দেশের কারণে, এমনকি চেতনার কারণেই চায় প্রগতিশীল বাংলাদেশ। কিন্তু জামায়াতের চেয়েও ভয়ংকর আসলে সুবিধাবাদী মধ্যবিত্ত ও সুশীলরা। এরা উস্কে দিয়ে নীরবে মজা দেখে। এরা বাজার করতে যায় কলকাতায়, কলকাতার গায়ক, লেখক বা কেউ আসলে পায়ে আছড়ে পড়ে কিন্তু অন্তরে ভারত ও হিন্দু বিদ্বেষ। আমজনতা এসবে নেই। তাদের মূর্খ বা লেখাপড়া না জানা অংশটি নিয়ে খেলে রাজনীতি।
খেলতে খেলতে এখন এমন এক জায়গায় নিয়ে এসেছে, মানুষের এক বিরাট অংশ হয়ে গেছে আচরণগত ধার্মিক আর সাম্প্রদায়িক। তারপরও দেখুন ঢাকায়, মানুষ আলো নিয়ে বের হয়েছে পথে। সারাদেশে মানুষের মনে ঘৃণা আর শোকের আবহ। সচেতন অসচেতন সকলেই একমত এভাবে চলে না। এদেশ সবার। সবার যদি নাই হবে কদিন আগে এত সুন্দর ও স্বাভাবিকভাবে পূজা হলো কীভাবে। আমি বলি, মানুষকে সঙ্গে নিন। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বঙ্গবন্ধুর দেশে আমরাই জয়ী হবো। কবিগুরু যেমন লিখেছেন, নিবিড় ঘন আঁধারে জ্বলিছে ধ্রুবতারা। তার আলো এখনো নেভেনি। জ্বালিয়ে রাখা সে পথ ধরলেই মুক্তি মিলবে আমাদের।
লেখক: সিডনি প্রবাসী, কলামিস্ট ও বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষক
সম্পাদনা: আশিক রহমান