সাম্প্রদায়িকতার জন্ম কবে, বাংলাদেশে?
ফিরোজ আহমেদ
বহুদিন ধরে ভেবেছি, লেবু ভাইয়ের একটা ছোট জীবনী লিখব। ওয়ালিউর রহমান লেবু খুন হয়েছিলেন ১৯৭৩ সালের জাতীয় নির্বাচনের কদিন পর। সঙ্গে খুন হন কমলেশ বেদজ্ঞসহ আরও দুজন রাজনৈতিককর্মী, গোপালগঞ্জেরই। তাদের অপরাধ ছিল, মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে তখন পর্যন্ত বৃহত্তর ফরিদপুরে হিন্দু সম্পত্তি দখল ও লুণ্ঠনে ব্যস্ত এক বিখ্যাত মুক্তিযোদ্ধার অপকীর্তির তালিকা তৈরি। না, এই চার শহিদ কোনো গোপন রাজনৈতিক দলের কর্মী ছিলেন না, বরং ছিলেন আওয়ামী লীগের মিত্র হিসেবে পরিচিত বামপন্থি ধারার নেতা এবং বিখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা।
জনতার রোষ থেকে খুনিকে বাঁচাতে নাকি ঢাকায় নিয়ে আসা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু খুনিদের শাস্তির আশ্বাস দিয়েছিলেন, অচিরেই অবশ্য সেই খুনি খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার মর্যাদা পেল। বিচার হয়নি। মাঝে মাঝেই ভাবি, বঙ্গবন্ধুর কাছে লেবু ভাই পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন ওই তালিকা, পৌঁছাতে পারলে কি হতো? দুই বছর আগে আবারও দেখা হলো শহিদ লেবু ভাইয়ের ভাইয়ের সঙ্গে, হাতিরপুলের ঢালে। ‘মামলা আবারও চালু করেছি, ছাড়ব না।’ খুনি হেমায়ত অবশ্য সবাইকে ফাঁকি দিয় চলে গেল পরপারে, মাত্র কদিন আগে।
হেমায়েতের লুণ্ঠনের তালিকা বঙ্গবন্ধুর কাছে পৌঁছাতে পারলে কি হতো আমরা জানি না। একইরকম দুঃখ নিয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন আরেকজন বিখ্যাত মানুষ। সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে কাজ করা আলোকচিত্রী আমানুল হক। মুক্তিযুদ্ধে নিপীড়িত নারীদের পুনর্বাসন বিষয়ে মারি সিটনের একটা বার্তা তিনি পৌঁছাতে চেয়েছিলেন। বঙ্গভবনের অভ্যর্থনা কক্ষে তাকে দিনের পর দিন ঠেকিয়ে রেখেছিলেন কর্মকর্তারা। আমানুল হক এই বিশ্বাস নিয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন যে, বঙ্গবন্ধুর কাছে পৌঁছাতে পারলে মুক্তিযুদ্ধে ধর্ষিতা নারী আর শিশুদের পুনর্বাসনের ইতিহাস ভিন্ন হতো। আমানুল হক যদি কোনো অলৌকিক উপায়ে পৌঁছে যেতেন বঙ্গবন্ধুর কাছে, কি হতো?
অন্য একটি প্রতিনিধি দল অবশ্য পৌঁছে গিয়েছিল। এদের ফরিয়াদের পরিণতির মতোই একই ফল হতো কিনা লেবু ভাইয়ের, আমানুল হকের, তা আমরা জানি না। কিন্তু এটুকু সবাই জানি, পাকিস্তান আমলের সবচেয়ে ঘৃণ্য আইন শত্রু সম্পত্তি আইন মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে বাতিল হয়নি। হিন্দু সম্পত্তি সহজে লুটে নেওয়াটাকে আইনসঙ্গত করার জন্যই পাকিস্তানি শাসকেরা বানিয়েছিল এই আইনটা। মুসলিম লীগ ছিল এই আইনের সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী পাকিস্তানে।
লেবু ভাইয়ের আত্মদান বড় একটা প্রতীক হিসেবে ফিরে আসবে বাংলাদেশে, প্রগতিশীল রাজনীতির বশ্যতার এবং সততার আশ্চর্য এক সমাহার হিসেবে হলেও, যদি কোনোদিন বাংলাদেশে দলবাজি থেকে ইতিহাসচর্চা মুক্তি পেতে শুরু করে। ইতিহাসের এই সব ‘খ- খ- গ্লানি’ স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রাপথের ভিন্ন একটা ইতিহাস রচনার সম্ভাবনা নিয়ে অপেক্ষারত। ভবিষ্যতের সেই ঐতিহাসিকদের অবশ্য হারিয়ে দিয়েছেন আখতারুজ্জামান তার দুইটি ছোটগল্প, ‘মিলির হাতে স্টেনগান’ আর ‘খোঁয়ারি’তে।
লেখক: কেন্দ্রীয় সদস্য, গণসংহতি আন্দোলন। সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন/ ফেসবুক থেকে