দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি, বিশ্বের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপট এবং আমরা
কাকন রেজা
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট
ভারত আর যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক চুক্তি যে অনেক কিছু পাল্টে দেবে সেটা অনেকেই আগে থেকে আঁচ করতে পেরেছিলেন। আমিও বলেছিলাম, এই চুক্তির প্রভাবে দক্ষিণ এশিয়ার রণ ও রাজনীতিতে একটি পরিবর্তনের কথা। বলেছিলাম, সে হাওয়ায় আমাদের রাজনীতির পালের দিক পরিবর্তনের সম্ভাবনা কিংবা আশঙ্কার কথা। এমন সব ধারণা যে খুব একটা ভুল হয়নি তার প্রমাণ, ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার দিকে চোখ ফেরালেই মেলে। ভারত যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র হওয়ার পর সঙ্গত কারণেই রাশিয়াকে দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন মিত্রের সন্ধানে নামতে হয়েছে। আর এক্ষেত্রে পাকিস্তানের বিকল্প কিছু নেই। বিশ্ব রাজনীতিতে ক্রমেই আমেরিকার ভয়াল প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছে চীন। অর্থ এবং অস্ত্রে অর্থাৎ অর্থনীতি আর রণনীতি দুটির ক্ষেত্রেই চীন এখন আমেরিকার অনেক বড় গাত্রদাহের কারণ।
বর্তমান বিশ্বে একটু পিছিয়ে পড়া রাশিয়া তাই কৌশলগত জোটের মাধ্যমে তার শক্তির ভারসাম্য রক্ষা করতে চাচ্ছে। আর সেই কৌশলগত কারণেই তাকে ক্রমেই সরে আসতে হচ্ছে চীনের কাছে। মধ্যপ্রাচ্যে আরেক অঘোষিত পারমাণবিক শক্তির অধিকারী মুসলিম রাষ্ট্র ইরান। যাকে আমেরিকাও কিছুটা সমীহ করে। আর মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী মিত্র হচ্ছে এই ইরান। তুরস্কের সাম্প্রতিক অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার কারণে তুরস্কও ছিটকে পড়ছে যুক্তরাষ্ট্র বাঁধন থেকে। সম্প্রতি রাশিয়ার সঙ্গে তিক্ততার অবসান করতে চাচ্ছে তুরস্ক। সুতরাং বিশ্ব রাজনীতিতে রাশিয়া আর চীন বিকল্প মুসলিম শক্তির সঙ্গে জোট বাঁধার দিকেই এগোচ্ছে বলেই ঘটনা পরম্পরায় প্রতীয়মান হচ্ছে।
বিশ্ব রাজনীতির এই সমীকরণে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সামরিক চুক্তি, বিশেষ করে উভয়ের সামরিক ঘাঁটি ব্যবহারের ক্লজটি দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির দর্শনটিও প্রায় উল্টে দিয়েছে। ভারত-পাকিস্তানের উত্তেজনাকে কেন্দ্র করে ‘দর্শনে’র এই রূপটি এখন অনেকটাই পরিষ্কার। যাদের চোখের দৃষ্টি ভালো তারা চশমা ছাড়া খালি চোখে আগেই দেখেছেন। যাদের দৃষ্টি স্বল্পতার জন্য চশমা পরতে হয় তারা ‘দর্শন’গত দিক দিয়ে একটু পিছিয়ে আছেন এই আর কি।
তবে লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনায় শক্তিমান ও ধনবানদের সমর্থনের দিক দিয়ে ভারত কিছুটা পিছিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সামরিক চুক্তি করলেও শক্তিমানদের সরাসরি সমর্থনের দিক দিয়ে এগিয়ে পাকিস্তান। চীন সরাসরি বলেছে, এমন পরিস্তিতিতে সে পাকিস্তানের পাশে থাকবে। রাশিয়ার সৈন্য তো পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে এমন পরিস্তিতিতেও যৌথ সামরিক মহড়াও সেরেছে এবং তাও পাকিস্তানেই। রাশিয়া আর চীনের কারণে কৌশলগতভাবে ভারতের আরেক মিত্র মুসলিম দেশ ইরানও নিরপেক্ষ ভূমিকায়। ওদিকে মুসলিম দেশ হওয়ায় সৌদি আরবের সমর্থন পেয়েছে পাকিস্তান। এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে প্রভাবশালী সংস্থা ওআইসির প্রচ্ছন্ন সমর্থন পাকিস্তানের দিকেই।
এমন পরিস্তিতিতে ভারতের সবচেয়ে বেশি এবং সরাসরি সমর্থন প্রয়োজন ছিল তাদের বর্তমান মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের এবং বিজ্ঞজনের ভাবনা ছিল এমনটিই। কিন্তু সবসময় সব ভাবনার হিসেব মেলে না। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের হিসেব ও অবস্থান কিছুটা কৌশলী। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর জানিয়েছে, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ভারত-পাকিস্তানের সাম্প্রতিক উত্তেজনা প্রশমনই সবচেয়ে ভালো পন্থা। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের বক্তব্য সবসময়ই কৌশল ও ভবিষ্যত হিসেবের যোগ-বিয়োগ মিলিয়েই প্রচারিত হয়।
তবে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের অবস্থান আপাত শক্তিশালী। চিরশত্রু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রতিবেশী বাংলাদেশ এবং আফগানিস্তানের সরাসরি সমর্থন আদায় করতে পেরেছে ভারত। আর এর ফলেই বাতিল হয়েছে সার্ক সম্মেলন। পাকিস্তান অনুষ্ঠিতব্য সার্ক সম্মেলন বাতিল হওয়া পাকিস্তানের দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে পিছিয়ে পড়ার লালসূচক প্রদর্শন করে। এটা ভারতের নিশ্চিত কূটনীতিক সফলতা। কিন্তু সদ্য সমাপ্ত ‘ব্রিকস’ সম্মেলন ভারতের এই কূটনৈতিক সফলতাকে অনেকটাই স্থান করে দিয়েছে। এ সম্মেলনে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জোট ‘বিমসটেক’ভুক্ত বাংলাদেশসহ পাঁচটি দেশকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। ‘ব্রিকস’ সম্মেলনে ভারত চেষ্টা করেছিল প্রভাবশালী এই জোট সম্মেলনের যৌথ ঘোষণাপত্রে পাকিস্তানকে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে আখ্যায়িত করার। কিন্তু ভারতের এই সমীকরণটি মেলেনি। জোটের দুই প্রভাবশালী সদস্য চীন ও রাশিয়া সরাসরি ভারতের এই প্রাণান্ত চেষ্টায় পানি ঢেলে দিয়েছে এবং উল্টো সাফাই গেয়েছে পাকিস্তানের পক্ষে। চীন ও রাশিয়ার এমন সমীকরণের কথা প্রথম থেকেই বলে আসছিলাম। বিশেষ করে, ভারত-আমেরিকার চুক্তির পর এ দৃশ্যপটই ছিল স্বাভাবিক।
লেখার প্রথমেই আমাদের রাজনীতির পালের দিক পরিবর্তনের কথা বলেছিলাম। বিশ্ব, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে যে পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে তার তোড়ে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর টিকে থাকতে হলে ‘ইগো’র উপর ভর দিয়ে থাকলে হবে না। হাওয়ার মুখে টিকতে হলে অবলম্বনের কথা ভাবতে হবে। যেহেতু অর্থ ও অস্ত্রে আমরা পিছিয়ে সুতরাং আমাদের এগিয়ে থাকতে হবে কৌশলে। অত্যন্ত ঠা-া মাথায় দূরদর্শী আর কৌশলী সিদ্ধান্তই পারে আমাদের এগিয়ে নিতে এবং টিকে থাকতে।
২৭ সেপ্টেম্বর ‘বাংলা ট্রিবিউন.কম’ একটি খবর ছিল এ রকম, ‘রাশিয়ার সঙ্গে নতুন ১০টি চুক্তি করতে চায় বাংলাদেশ’। এ খবরের শেষাংশে গণমাধ্যমটি বাংলাদেশের একজন কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে বলেছে, ‘মস্কো ঢাকার সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ করতে চায়। পরিবর্তনশীল বিশ্ব ঘটনাপ্রবাহে রশিয়া বাংলাদেশকে পাশে চায়।’ গণমাধ্যমটির বক্তব্য অনুযায়ী যদি বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এমন বক্তব্য হয় তাহলে বোঝা যাচ্ছে, পরিবর্তনের হাওয়া আমাদের রাজনীতির পালেও লাগতে যাচ্ছে।
গণমাধ্যমে বাংলাদেশি কর্মকর্তার বরাতে রাশিয়ার যে মনোভাবের কথা বলা হয়েছে তাতে, ‘পরিবর্তনশীল বিশ্ব ঘটনাপ্রবাহে রাশিয়া বাংলাদেশকে পাশে চায়’ এমন কথাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে স্পষ্টতই পরিবর্তনকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। আর পরিবর্তন এখন ক্রমশই প্রতীয়মান হচ্ছে বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহে।
একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের প্রধান মিত্র ছিলÑ ভারত ও রাশিয়া। ভারত সরাসরি বাংলাদেশের হয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে, আর রাশিয়া অর্থাৎ তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের হয়ে কূটনৈতিক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। সে সময়ের যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের ভূমিকাকে বাংলাদেশের অনেকেই কঠোর সমালোচনার দৃষ্টিতে দেখেন। আর বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও মিত্র নির্ধারণের ক্ষেত্রে এমন সমীকরণেরই উদাহরণ টানা হয়।
কিন্তু বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতি এমন সমীকরণটি অনেকটাই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের প্রধান মিত্র ভারত। বর্তমানেও সরকার স্বীকৃত অন্যতম প্রধান মিত্র ভারত। কিন্তু একাত্তরের আরেক প্রধান মিত্র রাশিয়া একাত্তরে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ পাকিস্তানের সঙ্গে যৌথসামরিক মহড়ায়। উপমহাদেশের উত্তেজনায় প্রচ্ছন্ন সমর্থনও দিয়েছে পাকিস্তানকে। আর সেই রাশিয়ার সঙ্গেই বাংলাদেশ ‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প’ বাস্তবায়ন করছে এবং আরও গুরুত্বপূর্ণ দশটি প্রকল্পের বিষয়ে চুক্তি করতে চাচ্ছে। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বিরোধিতাকারী হিসেবে আখ্যায়িত যুক্তরাষ্ট্র সামরিক চুক্তি করছে ভারতের স্বার্থে। সব মিলিয়ে বিষয়টি অনেকটা গোলমেলে ও আপাত ঘোলাটে।
কিন্তু বিশ্ব রাজনীতির পরিবর্তনের হাওয়া দক্ষিণ এশিয়া এবং আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির পালে যেভাবে আঘাত করছে তাতে দক্ষিণ এশিয়ার পরিবর্তিত রাজনৈতিক দৃশ্যপট অনেকটাই পরিষ্কার। সম্মুখে হয়তো অভ্যন্তরীণ রাজনীতির আপাত ঘোলাটে বিষয়টিও আমাদের চোখে পরিষ্কার হয়ে যাবে।
সম্পাদনা: আশিক রহমান