সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাংলাদেশে কেন এই হামলা?
মিল্টন বিশ্বাস
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্যরা এখনো চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। ৩০ অক্টোবর (২০১৬) ১৫টি মন্দির ও শতাধিক বাড়িতে নারকীয় হামলা এবং কিছুদিন পরে পুনরায় কয়েকটি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ আর প্রতিমন্ত্রী ছায়েদুলের নানা ধরনের বক্তব্য তাদের এই প্রিয় স্বদেশ ভূমিতে অসহায় করে তুলেছে। যদিও বর্তমান সরকারের নানামুখি পদক্ষেপ এবং হিন্দুদের নিরাপত্তা নিয়ে ভারতের উদ্বেগ ও আওয়ামী লীগের দলীয় উদ্যোগে সমস্যা মোকাবেলায় তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে কিন্তু শেষ পরিস্থিতিতে নিরীহ জনগোষ্ঠীর মনোবল ফিরিয়ে আনতে দরকার আরও বেশি প্রশাসনিক গতি এবং নিবিড় পর্যবেক্ষণ। একথা সত্য হরহামেশায় আমরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা বলে থাকি কিন্তু উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে স্থানীয় পর্যায়ে হিন্দু-খ্রিস্টান- বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর সদস্যদের প্রতি সাম্প্রদায়িক ও বৈরি আচরণ নিয়ে কথা বলি না। কিংবা সাম্প্রদায়িক আচরণের অভিযোগ পেলেও দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকি। অথচ মুক্তিযুদ্ধ ও প্রগতিশীল চেতনা জাগ্রত রাখতে বাংলাদেশের সকল জনগোষ্ঠীর সম্মিলিত কর্মপ্রয়াসকে বারবার সামনে আনা হয়। এজন্য কঠোর আইন ও জিরো টলারেন্সের মধ্য দিয়ে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রচেষ্টা জরুরি হয়ে দেখা দিয়েছে।
দুই. একথা সকলের নিশ্চয় মনে আছে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে যে সহিংসতা শুরু হয়েছিল তার ভয়ঙ্কর রূপটি শেষ হয় নির্বাচনোত্তর হিন্দু-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর ওপর নির্মম আঘাতের মধ্য দিয়ে। সেসময় গ্রামের পর গ্রামের অমুসলিম জনগোষ্ঠী আক্রান্ত হয়েছেন। বীভৎস অত্যাচার আর লুটপাটের শিকার হয়েছেন সাধারণ সহজ-সরল নারী-পুরুষ। আহত ও নিহতের সংখ্যা দিয়ে সেই নিপীড়ন বিবেচনা না করে বরং ধর্মীয় সংখ্যালঘুর অস্তিত্ব সংকটের বাস্তবতা পর্যালোচনা করা দরকার। কারণ আমরা কথায় কথায় বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করে থাকি। কিন্তু অত্যাচার থেকে মুক্ত করা সম্ভব হয় না সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে। এমনকি আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও নির্মম সব ঘটনা ঘটেছে এদেশে। যদিও তা ২০০১-এর নির্বাচনোত্তর বিএনপি-জামাতের ব্যাপক হত্যা ও সহিংসতার মতো ছিল না। অন্যদিকে ২০১২ সালে কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম জেলার বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর ওপর আক্রমণের পর সংবাদপত্র লিখেছিল, ‘দেশ ও জাতির জন্য এক কলঙ্কজনক অধ্যায় রচিত হলো। গত শনি ও রবিবার কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম জেলার কয়েকটি স্থানে যে নারকীয় ঘটনা ঘটেছে তার নিন্দা জানানোর ভাষা আমাদের নেই। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এ দেশের ইতিহাসে এ ধরনের জঘন্যতম ঘটনার উদাহরণ আর একটিও পাওয়া যাবে না। অন্য দেশের সাম্প্রদায়িক ঘটনার সুযোগ গ্রহণ করে অতীতে কুচক্রী মহল বিচ্ছিন্নভাবে সাম্প্রদায়িক সংঘাত ঘটালেও গত শনি ও রবিবারের ঘটনা নজিরবিহীন।’ বৌদ্ধ সম্প্রদায় যে এদেশেরই ভূমিসন্তান; অনেক আগে থেকেই বসতি এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করে আসছে; তারও অনুপুঙ্খ পর্যালোচনা উপস্থাপন করে তাদের ওপর জঘন্য হামলার নিন্দা ও বিচারের দাবি জানানো হয়েছিল সেসময়।
নাসিরনগরে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জাতীয় ও আঞ্চলিক দৈনিক এবং সাপ্তাহিকসহ অনেক ইলেক্ট্রনিকস ও অনলাইন সংবাদ মাধ্যম একাত্ম হয়েছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার জন্য এদেশের মিডিয়ার এই ইতিবাচক ভূমিকা আমাদের মতো খ্রিস্টান ধর্মবিশ্বাসীদেরও আশ্বান্বিত করে তুলেছিল। কিন্তু শান্তিপ্রিয় খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের নানান সংবাদ আমাদের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ‘পাবনায় খ্রিস্টান পরিবারের জমি দখলের চেষ্টা’ সংবাদের মতো জামালপুর, চট্টগ্রামের কালুরঘাট, চুয়াডাঙ্গা, গোপালগঞ্জ, মৌলভীবাজার, কুড়িগ্রাম, নিলফামারী, ঝিনাইদহ প্রভৃতি এলাকায় খ্রিস্ট বিশ্বাসীদের জমি দখল থেকে শুরু করে শারীরিক নির্যাতনের নানান সংবাদ এদেশে বেঁচে থাকার বিষয়ে আমাদের সংশয়গ্রস্ত করে তুলেছে। অর্থাৎ কেবল হিন্দু বা বৌদ্ধ সম্প্রদায় নয় খ্রিস্টান সম্প্রদায়ও আজকের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। এমনকি বরিশালের ব্যাপ্টিস্ট চার্চের ভূ-সম্পত্তি দখলের সংবাদ প্রকাশ করে প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছে সংবাদপত্রই; যদিও সেই দখল প্রচেষ্টার কোনো সুরাহা হয়নি আজও।
লেখক: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সম্পাদনা: আািশক রহমান (চলবে…)