ইতিহাস গড়ছেন হিলারি
পরাগ মাঝি: এ প্রতিবেদন লেখার সময় আমেরিকার সবগুলো অঙ্গরাজ্যেই পুরোদমে চলছে ভোটাভুটি। এ অবস্থায় শুধু আমেরিকা নয়, সারা পৃথিবীতেই রব তুলেছেন ডেমোক্রেট প্রার্থী হিলারি। তাই বিশ্বের প্রায় সব গণমাধ্যমেই প্রতিফলিত হচ্ছে- তারই জয়গাঁথা। দুদিন আগেই নির্বাচনি লড়াইয়ের শেষ মুহূর্তের দৌড়ে হিলারি যখন ফিলাডেলফিয়ায় অবস্থান করছিলেন, সেখানকার একটি চার্চে কালো রঙের এক ছোট্ট মেয়ে গেয়ে ওঠেÑ ‘আমেরিকা দ্য বিউটিফুল’ এ গানটি। পরম মমতায় হিলারি এসময় তাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। রুদ্ধশ্বাস নির্বাচনি প্রচারণায় হিলারির এমন প্রশান্ত রূপ আগে দেখা যায়নি। কারণ, এ ঘটনার কিছুক্ষণ আগেই অনবরত হুল ফোঁটাতে থাকা এফবিআই ঘোষণা করে, প্রেসিডেন্ট হওয়ার পথে হিলারির গায়ে অবশিষ্ট নেই আর কোনো কালিমা।
আমেরিকানরা তাদের প্রেসিডেন্ট বাছাইয়ের ক্ষেত্রে প্রতিবারই একটি চমক রাখতে চায়। এবারের চমক যে হিলারি, তা খোলা মনে বলে দেবে যে কেউ। কারণ নির্বাচিত হলে তিনিই হবেন দেশটির প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট। আমেরিকানদের জন্য এ শুধু চমকই নয়, বরং এর মধ্য দিয়ে তারা রচনা করতে যাচ্ছে নতুন এক ইতিহাস।
নির্বাচনি প্রচারণার শুরুটাও হয়েছিল এভাবেই। প্রেসিডেন্ট হওয়ার দৌড়ে শুরু থেকেই বিভিন্ন জরিপে হিলারি তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে পরিষ্কার ব্যবধানে এগিয়েছিলেন। যদিও এফবিআই ও উইকিলিক্স বিড়ম্বনার সুযোগ নিয়ে তার ঘাড়ে কিছু সময়ের জন্য নি:শ্বাস ফেলেছিলেন ব্যবসায়ী ট্রাম্প। আর এ মুহূর্ত পর্যন্ত হিলারি যেন ট্রাম্পকে বুঝিয়ে দিয়েছেন কোনটা ব্যবসা আর কোনটা রাজনীতি।
রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে এ সময়টা একটু বিব্রতকরই বটে। তার এমন অনুভূতি শুরু হয়েছিল এফবিআইপ্রধান কর্তৃক হিলারিকে নিষ্কলুষ ঘোষণার পর থেকেই। তার এক টুইট বার্তায়ও পরিষ্কার হয়েছিল এ ব্যাপারটি। আর এদিকে পাত্তা নেই তার অনুকুলে বাতাস দেওয়া উইকিলিক্স প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জেরও। যে কি-না ঘোষণা দিয়েছিল, তার পরবর্তী তথ্য ফাঁস জেল খাটাবে হিলারিকে। সে আর হবে কখন- হিলারি প্রেসিডেন্ট হলে তবেই?
ব্রিটিশ গণমাধ্যম রয়টার্স তাদের সর্বশেষ জরিপ পর্যালোচনা করে জানায়, নির্বাচনে হিলারির বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় ৯০ ভাগ।
রয়টার্স জানায়, নির্বাচনের পূর্ব মুহূর্তের জরিপে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা হিলারি সর্বশেষ পপুলার ভোটে ৪৫/৪২ ব্যবধানে ট্রাম্পের চেয়ে এগিয়ে আছেন। আর ইলেক্টোরাল কলেজের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, হিলারি ৩০৩ ভোট পাবেন; যেখানে ২৭০টি ভোট পেলেই তার হোয়াইট হাউসে যাওয়া নিশ্চিত। অন্যদিকে, ট্রাম্প ২৩৫ ভোট পাওয়ার পথে রয়েছেন।
তবে, এ পরিসংখ্যানটি নির্ভর করছে মূল নির্বাচনে ছয় অথবা সাতটি অঙ্গরাজ্যে শ্বেতাঙ্গ, কৃষ্ণাঙ্গ ও হিস্পানিকদের ভোট কী পরিমাণ পড়ছে তার উপর।
ফ্লোরিডা, মিশিগান, নর্থ ক্যারোলিনা এবং ওহিওতে ভালো করতে পারলে তবেই পাশার গুটি উল্টাতে পারবেন ট্রাম্প। জরিপে এসব অঙ্গরাজ্যেই হিলারির খুব কাছাকাছি অবস্থান করছেন ট্রাম্প। তবে, ট্রাম্পকে এ চ্যালেঞ্জটুকু নিতে হবে সবগুলো অঙ্গরাজ্যের ক্ষেত্রেই; এ সবের কোনো একটি মিস হলেই লড়াইয়ে টিকে থাকা তার জন্য কঠিন হবে। রিপাবলিকানদের স্টেট বলে পরিচিত অ্যারিজোনায় ট্রাম্পের জয় নিশ্চিত হলেও বাকি তিনটি তার জন্য ফাঁড়া।
রয়টার্স জানায়, জেতার জন্য শ্বেতাঙ্গ ভোটারদের মধ্যে ট্রাম্পকে ব্যাপক সাড়া ফেলতে হবে। যদিও নির্বাচনের আগে ট্রাম্প এটি কিছু মাত্রায় করতে সক্ষম হয়েছেন বয়স্ক শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে। তবে, তার প্রতিদ্বন্দ্বী হিলারি তরুণ এবং কলেজ শিক্ষিত শ্বেতাঙ্গদের ইতোমধ্যেই তার দিকে নজর ফেরাতে সক্ষম হয়েছেন।
এবার আসা যাক নর্থ ক্যারোলিনা প্রসঙ্গে। সবার আগে এ অঙ্গরাজ্যের ফল প্রকাশিত হওয়ার কথা। এখানে হিলারির জিতে যাওয়া মানেই, এটা বুঝে নেওয়া যে, আফ্রো-আমেরিকানরা ২০১২ সালের মতো ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে আরও একবার। যদিও ২০১২ সালে ওবামা এ অঙ্গরাজ্যে ২ পয়েন্টে মিট রমনির কাছে হেরে গিয়েছিলেন। তবে, রমনিকে জাতীয়ভাবে তিনি চার পয়েন্টে হারিয়েছিলেন। হিলারি অবশ্য এখানে পূর্ব জরিপগুলোতে এক পয়েন্ট পিছিয়ে আছেন।
ফ্লোরিডায় ২৯টি ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট রয়েছে। এখানে যদি হিলারি জিতে যান তবে বাকি তিনটি বড় অঙ্গরাজ্য যেমন- ওহিও, মিশিগান ও প্যান্সিলভানিয়ার মধ্যে যেকোনো একটিতে জিতে গেলেই হিলারিকে আর পায় কে? ফ্লোরিডায় হিলারি ৪৮/৪৭ ব্যবধানে ট্রাম্পের চেয়ে জরিপে এগিয়ে আছেন। এ অঙ্গরাজ্যে হিলারি কালো ভোটারদের ক্ষেত্রে ৭৫ পয়েন্ট ও হিসপানিকদের ক্ষেত্রে ২০ পয়েন্টে ট্রাম্পের চেয়ে এগিয়ে আছেন। আর শ্বেতাঙ্গ ভোটারদের ক্ষেত্রে হিলারির চেয়ে ৩০ পয়েন্ট লিড ধরে রেখেছেন ট্রাম্প। হিলারিকে এখানে জয়ী হতে হলে কৃষ্ণকায় ভোটারদের ব্যাপক হারে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হবে।
মিশিগান এবং ওহিওতে দুজনের ব্যবধান খুব কাছাকাছি হলেও প্যানসিলভানিয়ায় দারুণভাবে এগিয়ে আছেন হিলারি।
প্রজেক্ট অনুযায়ী, অ্যারিজোনায় ট্রাম্প হিলারির চেয়ে ৫ পয়েন্টে এগিয়ে থাকলেও সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোর জরিপে এখানে ধীরে ধীরে হিলারির জনসমর্থন বেড়েছে। শেষ পর্যন্ত এটি অব্যাহত থাকলে ট্রাম্পের জন্য বেশ চিন্তার কারণ হবে।
এসব তো গেলো জরিপের কথা। এ ছাড়া বেশিরভাগ রাজনৈতিক বোদ্ধাই অভিমত দিয়েছেন হিলারিই সেরা প্রার্থী। ব্রিটেনের প্রভাবশালী ইকোনমিস্টের এক লেখার শিরোনাম ছিলÑ যুক্তরাষ্ট্রের সেরা ভরসা হিলারি। ওদিকে, গার্ডিয়ান লিখেছেÑ গোটা বিশ্বের জন্যই ভরসা হিলারি ক্লিনটন। কেননা, মার্কিন নির্বাচন মার্কিন মুলুক ছাপিয়ে পুরো বিশ্বের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। রিপাবলিকান প্রার্থী ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে যোগ্য ননÑ এমন অভিমত দিয়েছেন অনেকে। হিলারি ক্লিনটন শুধু যে এ কারণেই সেরা পছন্দ তা কিন্তু নয়। সফলতার সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ সরকারি দায়িত্ব পালনের প্রুভেন ট্র্যাক রেকর্ড রয়েছে তার। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে অত্যন্ত সফল ছিলেন হিলারি। বিশ্বব্যাপী নারী স্বাধীনতা ও মানবাধিকার নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন তিনি।
সবশেষে সবার আগে লেখা একটি বাক্যের পুনরাবৃত্তি করা যাক আরও একবার। আর তা হলো- প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বরাবরই চমক রাখতে চায় আমেরিকানরা। আর চমক তো তা-ই যা হয় তাৎক্ষণিক। তাই নির্বাচনের ফল যা-ই হোকনা কেন, তা যে চমক হবে সবার জন্য- তা হলফ করে বলে দেওয়া যায়। সম্পাদনা: আলাউদ্দিন