গণগ্রেফতারে সামাজিক সম্প্রীতি বিনষ্টের আশঙ্কা
রিকু আমির, নাসিরনগর (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) থেকে : ‘আমি না হয় হিন্দু। পুলিশ কিছু কয় না। দোকান খুইলা রাখতে পারি। কিন্তু কাস্টমারইতো নাই। আমার বেশিরভাগ কাস্টমার মুসলমান। তাগো চেহারাইতো দেখি না।’ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের ফান্দাউক বাজারের বস্ত্র ব্যবসায়ী অনিল আমাদের অর্থনীতিকে এসব কথা বলেন। সম্প্রতি একের পর এক সাম্প্রদায়িক হামলার প্রেক্ষিতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যাপক অভিযানে সাধারণ মানুষ হয়রানির শিকার হচ্ছে বলে অভিযোগের প্রেক্ষিতে এসব কথা বলেন তিনি।
নাসিরনগর উপজেলার দুজন প্রভাবশালী হিন্দু নেতার ভাষ্যমতে- যেভাবে ধরপাকড় হচ্ছে, চোখ বন্ধ করে যাকে তাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে, এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। হিন্দু-মুসলমানে সম্পর্কটা আরও অবনতি ঘটবে। সমাজে তো আমাদের মিলেমিশেই চলতে হবে। মুসলমানদের অযথা হয়রানির জেরে সামাজিক অশান্তি হলে কে নেবে, এর দায় ভার? বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় তারা নাম না প্রকাশের অনুরোধ জানিয়ে বলেন, এভাবে গণগ্রেফতারে সামাজিক সম্প্রীতি বিনষ্টের আশঙ্কা আছে।
সরেজমিনে জানা যায়, গত শুক্রবার দুপুরে অসুস্থ শ্বশুরকে দেখতে নিজবাড়ি নাসিরনগরের ধানতলিয়া গ্রাম থেকে নূরপুর লাহাজুড়ায় স্ত্রীসহ এসেছিলেন কাতার প্রবাসী সৈয়দ জিয়াউল হক (পাসপোর্ট নং বিএল-০২৫০১১০)। ধানতলিয়ার পীর বাড়ির ছেলে জিয়াউলকে সেই রাতেই পুলিশ গ্রেফতার করে। তার স্ত্রী সৈয়দা লাইলী জানান, সে রাতে পুলিশ এসে দরজা টোকা দিলে ঘুম থেকে উঠে জিয়া দরজা খুলে দেন। এ সময় পুলিশ তাকে শার্ট গায়ে দিয়ে থানায় যেতে বলে। লাইলী স্বামীর হাত না ছাড়ায় পুলিশ তাকে লাথি মেরে ফেলে দেয় বলে অভিযোগ করেন লাইলী। ঠোঁট-মুখ ভেঙে কান্নারত লাইলী প্রশ্ন রাখেন, আমার অসুস্থ বাবাকে দেখতে আসা কী অন্যায়?
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর সাধারণ সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, অপ্রিয় হলেও সত্য, আমাদের দেশে পুলিশের বিরুদ্ধে গ্রেফতার বাণিজ্য বা হয়রানিমূলক গ্রেফতারের অভিযোগ ওঠে। নাসিরনগরে যদি এমন হয়, সেটা খুব দুর্ভাগ্যের এবং আশঙ্কার। কেননা যারা হয়রানির শিকার হবেন, তাদের মধ্যে একটা ক্ষোভ জন্মাতে পারে। এই ক্ষোভ কোথায়, কীভাবে গড়ায়, সেটাই ভাববার বিষয়, ভয়ের বিষয়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান বলেন, কাউকে হয়রানি করা হচ্ছে না। ভিডিও ফুটেজ, গ্রেফতারকৃদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য, স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতেই গ্রেফতার করা হচ্ছে। যদি তদন্তে দেখা যায়, তারা নির্দোষ, অবশ্যই ছেড়ে দেয়া হবে, হয়রানির সুযোগ নেই।
প্রসঙ্গত, বর্তমানে দিনে কিছুটা কম হলেও গ্রেফতার আতংকে রাতে প্রায় পুরুষশূন্য হয়ে পড়ে নাসিরনগর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের মুসলমানদের ঘরদোর। অভিযোগ পাওয়া গেছে নাসিরনগরে হামলার সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণ দেখিয়ে পুলিশ নিরীহ, খেটে খাওয়া এসব সাধারণ মানুষকে গ্রেফতার করছে। এসব কারণে একটি সময়, স্বল্পমেয়াদে হলেও হিন্দুদের সঙ্গে মুসলমানদের মানসিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্কে তিক্ততা সৃষ্টি হতে পারে, এমনকি বড় ধরনের গোলোযোগ সৃষ্টির আশঙ্কাও তৈরি হচ্ছে। গত দুইদিন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের অন্তত ৩০টি গ্রাম ঘুরে এমন আভাস পাওয়া গেছে। আশঙ্কার কথা ব্যক্ত করেছেন হিন্দু-মুসলিম গ্রামবাসীরা।
সরেজমিনে গোকর্ণ, কুন্ডা, নাসিরনগর সদর, বুড়িশ্বর, ফান্দাউক, চাপরতলা, পূর্বভাগ ইউনিয়নের ১৪টি বাজারে ঘুরে জানা যায়, হামলা ঘটনার পর মামলা দায়ের যেদিন হয়েছে, সে রাত থেকেই পুলিশ গণহারে গ্রেফতার শুরু করে। বিশেষ করে রাতেই এ অভিযান পরিচালনা করা হয়। কোনোরকমে দিনে গুটিকয়েক ব্যবসায়ী আধাআধি বেচাকেনা করে সন্ধ্যা হতে না হতেই সব দোকানপাট বন্ধ করে লুকাতে যান। স্বাভাবিকভাবে এ ১৮টি বাজারই সকাল থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত জমজমাট থাকে। দোকানপাট খুব একটা খোলা না থাকলেও মানুষজনের চলাচল ঠিকই থাকে। সম্পাদনা : মাহমুদুল আলম