স্বাভাবিক জীবনে নেই হিন্দু পরিবারগুলো
রিকু আমির, নাসিরনগর (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) থেকে: ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের কাশীপাড়ার পালন সূত্রধরের ছেলে অনিক সূত্রধরের পিএসসি (প্রাথমিক সমাপনী) পরীক্ষা খুব কাছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক হামলার দিন থেকে এ পর্যন্ত স্কুলে গিয়েছে মাত্র একদিন। তাও আধাবেলা করে চলে এসেছে বলে জানান অনিকের মা অঞ্জনা সূত্রধর। এই প্রতিবেদককে তিনি জানান, ভয়ে সন্তানকে স্কুলে পাঠাতে চান না। কিন্তু পরীক্ষার কথা ভেবে না পাঠিয়েও পারেন না। সন্তান স্কুলে যেতে ভয় পায়। ঘরে থাকলেও শুধু হামলা নিয়ে গল্প করে, নানা ধরনের আশংকামূলক প্রশ্ন করে।
আর পশ্চিমপাড়ার সাইফুল ইসলাম জানান, হিন্দু বন্ধুদের জন্য তার খারাপ লাগে। তার কিছু বন্ধুর বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু ভয়ে পারিবারিক নিষেধাজ্ঞা, গ্রেফতারের ভয় থাকায় দেখতে যেতে পারেন না। মাঝে মধ্যে মোবাইল ফোনে কথা বলেন।
কাশীপাড়ার হরিদাস সূত্রধরের ছোট মেয়ে প্রীতি সূত্রধর বলেন, বিশ্বাস করবেন, রাতে ঘুম হয় না। একটু শব্দে ঘুম ভাংলেই বুক কেঁপে উঠে। জেলা প্রশাসন ও জেলা পুলিশ থেকে তিন দফায় ১৬ হাজার টাকা ও তিন বান্ডেল টিন পেয়েছে পরিবারটি।
প্রীতি বলেন, কিছুই তো নাই। হাটবাজার, পড়াশোনা, কাপড়- চোপড়, রান্নার সরঞ্জাম কেনা, খুবই দরকারী ঘরোয়া জিনিস কেনা, ঘরের প্রার্থনা কক্ষ নতুন করে তৈরিসহ সব ধরনের নিত্যখরচ এই টাকা দিয়েই করতে হবে। আবার ঘরের কাজের পেছনেও খরচ। কীভাবে কী করব, মাথায় ধরে না। পার্শ্ববর্তী চাচার বাড়ির হাড়ি-পাতিল দিয়ে চাচার চুলাতেই রান্না ও চাচার থালা-বাটিতেই খাবার খেতে হচ্ছে বলে জানান প্রীতি সূত্রধর।
নাসিরনগর কলেজের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জামিল ফোরকান গতকাল সন্ধ্যায় এ প্রতিবেদককে বলেন, ঘটনা কেন্দ্র করে যত ধরনের সামাজিক যোগাযোগে ভাটার কথা বলা হচ্ছে- তা স্বাভাবিক করতে স্থানীয় বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠন, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনকে কাজ করা উচিৎ। সব ধরনের মানুষের কাছে বার্তা পৌঁছানো দরকার, অভয় দেয়া দরকার। যাতে কেউ নিজেকে একা, অসহায়, বিচ্ছিন্ন মনে না করে। বোঝাতে হবে- একটি অঘটন ঘটে গেছে, এখন আমরা হিন্দু-মুসলমান ভাই-ভাই, আমরা সবাই এক।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিউট হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. আহমেদ হেলাল মনে করেন- মানব সৃষ্ট এ দুর্যোগ থেকে আক্রান্তদের মানসিক অবস্থা ঠিক করার জন্য দরকার মনোসামাজিক নিরাপত্তা (সাইকো সোশ্যাল কেয়ার)। এর সঙ্গে স্থানীয় সব ধরনের মানুষকে যুক্ত করতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, সাধারণত এসব ঘটনা থেকে সৃষ্ট মানসিক সমস্যাকে একিউট স্ট্রেস ডিজঅর্ডার বলা হয়। মনোসামাজিক নিরাপত্তার একটি অংশ সাইকোলজিক্যাল ফাস্ট এইড। এটা দেয়া খুবই জরুরি।
তিনি বলেন, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নিয়মানুযায়ী- যে কোনো দুর্যোগ ঘটার সময় মানুষ মানসিকভাবে যে আঘাতপ্রাপ্ত হয়, তা সারিয়ে তুলতে অবশ্যই এই ফাস্ট এইড দিতে হবে। যদি এসব কাজ না করা হয়, ভবিষ্যতে আক্রান্তরা বিষণœœতাসহ নানা রকম মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হবে। বিশেষ করে শিশু-নারী-বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে ভয় বেশি। আবার বৃদ্ধরা যদি হতাশ হন, সেটার প্রভাব পড়বে তরুণদের উপর, তারা মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়বেন।
তিনি আরও বলেন, মনোসামাজিক নিরাপত্তা না দিলে যে মানসিক সমস্যা সৃষ্টি হবে, তা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বিস্তার লাভ করবে। যেহেতু শিশুরাও আছে।
আহমেদ হেলাল পরামর্শ দেন- যদি সেখানে স্থায়ীভাবে, লম্বা সময়ের জন্য মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের নিয়ে মনোসামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা চালু করতে সমস্যা হয়, তবে কিছু মনোরোগ বিশেষজ্ঞকে সেখানে নিয়ে স্থানীয়দের প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজ শুরু করতে হবে। এ কাজ সরকারের মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ক্ষেত্রে সম্ভব। রানা প্লাজা ট্রাজিডিসহ আরও কিছু ঘটনায় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট সাইকোলজিক্যাল ফাস্ট এইড দিয়েছিল বলেও উল্লেখ করেন ডা. হেলাল উদ্দিন। সম্পাদনা : মাহমুদুল আলম