মিস্ত্রি সংকটে নিজের ঘর নিজেই মেরামত ঘুরে দাঁড়ানোর সংগ্রামে নাসিরগরের ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দু পরিবারগুলো
রিকু আমির, (নাসিরনগর) ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে : সব দুঃখ-কষ্ট, ভয়-ভীতি, মানসিক দুর্বলতা-কষ্টসহ বিভিন্ন প্রতিক’লতার মাঝেও সরকার এবং বিভিন্ন মাধ্যমে পাওয়া সহযোগিতায় ক্ষতিগ্রস্ত ঘরদোর মেরামত করে ঘুরে দাঁড়ানোর সংগ্রাম শুরু করেছে নাসিরগরের ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দু পরিবারগুলো।
যেসব পরিবার গত ৩০ অক্টোবর হামলার শিকার হয় কাবা শরিফের ছবি বিকৃতের ঘটনাকে কেন্দ্র করে। উপজেলা প্রশাসনের হিসেবে- ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দু পরিবারের সংখ্যা ৫৭টি আর আমাদের অর্থনীতি সরেজমিনে মোট ৫৯টি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের তথ্য পেয়েছে। এর মধ্যে নতুন করে পাওয়া গেছে- পশ্চিম পাড়ার জগন্নাথ মন্দিরের পুরোহিতের বাড়ির তথ্য।
সরেজমিনে গতকাল বুধবার সকালে ক্ষতিগ্রস্ত ৫টি পাড়ার মধ্যে ৪টি পাড়া পরিদর্শনে দেখা যায়, কিছু পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত বসতঘর মেরামতে হাত দিয়েছে। কিছু পরিবার কাজ শুরু করার প্রস্তুতি নিয়েছে, দিনক্ষণ ঠিক করেছে, মালামাল কিনছেনও কেউ কেউ। তবে তারা মিস্ত্রি পাচ্ছেন না। কেননা, মিস্ত্রির বাড়িঘরেও হামলা হয়েছে, তারা তাদের ঘরদোর মেরামত নিয়ে ব্যস্ত, আর মিস্ত্রি পেলেও মজুরি অনেক বেশি। তাছাড়া এই মৌসুমে অধিকাংশ মিস্ত্রি নৌকা তৈরি নিয়েই ব্যতিব্যস্ত বেশি। মিস্ত্রি না পাওয়ায় পরিবারের সদস্যরা যার যার ঘর মেরামতে নেমে পড়েছেন। তবে পরিবারগুলোর দাবি- প্রাপ্ত সহযোগিতা দিয়ে ঘরদোর মেরামত পূর্ণাঙ্গভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব না। একইসঙ্গে পরিবারের নিত্যখরচ মেটানোও সম্ভব নয় প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে। তাছাড়া পরিবারের কর্মজীবীরা ভয়, হতাশা, অনিশ্চয়তা, এলাকার স্থবির পরিস্থিতিসহ বহু প্রতিকূলতার কারণে কর্মক্ষেত্রে নিজেকে জড়াতে পারছেন না। কারো বা উপার্জনের অবলম্বন হামলায় ক্ষতিগ্রগ্রস্ত হয়ে ব্যবহার অনুপোযোগী হয়ে পড়েছে। এতে তাদের আয়ের পথ একদমই বন্ধ হয়ে গেছে।
কাশীপাড়ার মতিলাল দাসের বাড়িতে বুধবার সকাল ৯টার সময় দেখা যায়, তিনি তার স্ত্রী রীনাকে নিয়ে পেরেক ঠুকছিলেন, ঢেউটিন, কাঠে। মিস্ত্রিদের পাওয়া যায় না উল্লেখ করে তিনি বলেন, মিস্তুরের (মিস্ত্রি) লাইগ্গা তো ঘর উদাম (নষ্ট) রাখন যাইত না। রাইত হইলে উদাম ঘরে কুত্তা ঢুকে, বাতাসে ঠা-া লাগে, বৃষ্টির পানি ঢুকে- আরও কতো ঝামেলা।
তার স্ত্রী রীনা জানান, সেখানে একজন মিস্ত্রিও দৈনিক মজুরি ৪০০ টাকা। কিন্তু তিনি ৬০০ টাকা পর্যন্ত বলেছেন, তারপরও মিস্ত্রি আসে না। আরেকজন মিস্ত্রি তার কাছে দৈনিক মজুুরি দাবি করেছেন- ৮০০টাকা। কিন্তু পেশায় জেলে এ পরিবারের পক্ষে এটি দেয়া কষ্টসাধ্য।
এই পাড়ার ভানু দাস নিজ ঘর মেরামত করছিলেন স্ত্রী নমিতা দাসকে নিয়ে। ভানু জানান, সরকারের দেয়া ২ বান্ডেল ঢেউটিন, দুই দফায় পাওয়া ৮ হাজার টাকার বাইরেও জীবন-যাপনের জন্য আরও অর্থ দরকার। বর্তমানে কাজে যাওয়াও সম্ভব হচ্ছে না। তাই অভাব-অনটন পিছু ছাড়ছে না।
নমিতা দাস বলেন, পুরুষ হইতাম, তাইলে উদাম (আশপাশ খোলা) ঘরে থাকন যাইত। আমি তো মাইয়া মানুষ, ইজ্জতের কথা ভাবন লাগে। এজন্য কষ্ট হইলেও তাড়াতাড়ি ঘর ঠিক করার কাজে হাত দিসি। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন- যে আলামত হইছে, আরে বাইশা রে (বাপরে বাপ)। জীবনেও ভুলতাম না।
ঘোষপাড়ার গোপাল দাস তার বড় ভাই নান্টু দাসকে নিয়ে ঘর মেরামত করছিলেন। হামলায় তাদের বসত ঘরের বেশকিছু ঢেউটিন ও রান্নাঘর ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বুধবার সকালে তার বাড়িতে যখন যাওয়া হয়, তখন তিনি ২৫০ টাকার মেহগনি কাঠের টুকরা কাঁধে করে বাড়ি আনেন। এসব দিয়ে ঘরের কাজ করবেন। তিনি আমাদের অর্থনীতিকে বলেন, দুই বান (বান্ডেল) টিন, ছয় হাজার টাকা পাইলাম। কিন্তু মিস্ত্রি তো পাই না।
পূর্বপাড়া, গাংকল পাড়া ঘুওে মেরামতের দৃশ্য পাওয়া না গেলেও প্রস্তুতি গ্রহণের তথ্য মিলেছে। গাংকল পাড়ার মন্টু দাস জানান, তিনি সরকারের দেয়া ৩ বান্ডেল ঢেউটিন ও দুই দফায় ১১ হাজার টাকা পেয়েছেন। আজ বৃহস্পতিবার থেকে ঘর মেরামতের কাজে হাত দেবেন।
কাশীপাড়ায় বেশকিছু মিস্ত্রি বাড়ি আছে, হামলায় যাদের ঘরদোর ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এমন একটি পরিবারের কর্তা হরিদাস সূত্রধর বলেন, নিজের ঘরেই তো কামের শেষ নাই। নিজে বাঁচলে বাপের নাম। আগে নিজের ঘর ঠিক কইরা লই। পরে মাইনষের ঘর। যত টেহা দেক, যামু না, নিজের ঘর ঠিক না কইরা।
একই পাড়ার মিস্ত্রি পালন সূত্রধরসহ আরও কয়েকজন মিস্ত্রির সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, বর্তমানে এলাকায় নৌকা তৈরি, মেরামতের কাজেই এখানকার মিস্ত্রিরা ব্যস্ত থাকেন বেশি। কিন্তু হামলায় ঘরদোর নষ্ট হওয়ায়, মিস্ত্রি সংকট দেখা দিয়েছে। সবাই চায় দ্রুত এসব মেরামত করতে। মিস্ত্রি সংখ্যা খুবই কম হওয়ায় এটা সম্ভব না। তাছাড়া মিস্ত্রিরাও ক্ষতিগ্রস্ত।
তাদেও দেয়া তথ্যমতে- নাসিরনগর সদর ইউনিয়নে ৫০ জনের মতো এবং নাসিরনগর সদরে অন্ততঃ ১৫জন মিস্ত্রি আছেন, যারা ঘরদোর নির্মাণ ও মেরামতের কাজ করেন। এছাড়া গোটা উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নের একশরও বেশি গ্রামে ঘরদোরের কাজ করেন, এমন মিস্ত্রির সংখ্যা প্রায় ২০০ জনের মতো। উপজেলা সদরের মিস্ত্রি সংখ্যা কম হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্তরা অন্য ইউনিয়নের মিস্ত্রিদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন বলে জানা যায়।
উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান অঞ্জন কুমার দেব আমাদের অর্থনীতিকে বলেন, অবশ্যই আমরা খুশি যে, সরকারসহ বিভিন্ন মাধ্যম থেকে প্রাপ্ত সহযোগিতায় ক্ষতিগ্রস্তরা আবার আগের মতো জীবনে ফেরার চেষ্টা করছে।
গত সোমবার জেলা প্রশাসক রেজওয়ানুর রহমান যখন ঢেউটিন ও নগদ অর্থ বিতরণ করেন, তখন তিনি পরিবারগুলোকে দ্রুত ঘর মেরামতের তাগিদ দিয়েছিলেন। এরপর থেকে নিয়মিত জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা ক্ষতিগ্রস্তদের বাড়ি গিয়ে মেরামতের তাগিদ দেন বলে সরেজমিনে জানা যায়।
জেলা প্রশাসক রেজওয়ানুর রহমান আমাদের অর্থনীতিকে বলেন, সরকার ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে আন্তরিক। সহযোগিতা আরও করা হবে। একটু সময় লাগবে। ঘরদোর মেরামত করার পর তিনি পরিদর্শনে যাবেন বলে জানান। সম্পাদনা : শাহানুজ্জামান টিটু