বিশেষ মতায় আটকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার নয় রিমান্ডে মৃত্যুতে সরাসরি ব্যবস্থা নেবে আদালত
মাহমুদুল আলম : বিশেষ মতা আইনে আটক রাখার জন্য কাউকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করা যাবে না। আটক ব্যক্তি আইন-শৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীর রিমান্ডে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে মেডিকেল প্রতিবেদন পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সরাসরি ব্যবস্থা নিতে বিচারিক আদালতকে নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।
ফৌজদারি কার্যবিধির বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার (৫৪ ধারা) ও হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের ধারা (১৬৭ ধারা) প্রয়োগ নিয়ে এক নীতিমালায় এই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ দুই ধারা নিয়ে হাইকোর্টের রায় বহাল রেখে আপিল বিভাগের দেওয়া পূর্ণাঙ্গ রায়ে এসেছে এই নীতিমালা।
এতে বলা হয়, আইন-শৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীর কোনো সদস্য সন্দেহভাজন কাউকে হেফাজতে নিলে রিমান্ডের মেয়াদ শেষে তাকে আদালতে হাজির করা ওই কর্মকর্তার দায়িত্ব। এেেত্র পুলিশ রিপোর্ট বা অন্য কোনোভাবে ওই ব্যক্তির মৃত্যুর খবর পাওয়া গেলে বিচারক একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করে নির্যাতনের বিষয়টি পরীা করার নির্দেশ দেবেন। মৃত ব্যক্তিকে কবর দেওয়া হয়ে থাকলে লাশ তুলে পুনঃপরীা করতে হবে।
‘মেডিকেল প্রতিবেদনে নিপীড়নে মৃত্যুর বিষয়টি পাওয়া গেলে হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন অনুসারে ওই কর্মকর্তা, সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার কমান্ডিং কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অপরাধ আমলে নিতে হবে।’
‘মেডিকেল প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে নির্যাতনের ফলে হেফাজতে মৃত্যু বা নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে বলে প্রতীয়মান হলে বিচারক স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ওই অপরাধ আমলে নেবেন। মামলা দায়েরের অপো করবেন না।’
২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল হাইকোর্ট এক রায়ে ৫৪ ও ১৬৭ ধারার কিছু বিষয় সংবিধানের কয়েকটি অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করে। ৫৪ ধারায় গ্রেফতার ও হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে প্রচলিত বিধি ছয় মাসের মধ্যে সংশোধন করার পাশাপাশি ওই ধারা সংশোধনের আগে কয়েক দফা নির্দেশনা অনুসরণ করতে বলা হয় সরকারকে।
এর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপরে করা আপিল গত ২৪ মে খারিজ করে দেয় দেশের সর্বোচ্চ আদালত। এর ফলে হাইকোর্টের রায়ই বহাল থাকে। তবে ৫৪ ধারা ও ১৬৭ ধারা প্রয়োগের েেত্র একটি নীতিমালা দেওয়া হবে বলে আপিল বিভাগের রায়ে জানানো হয়।
গতকাল ৩৯৬ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর অতিরিক্ত আ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা গণমাধ্যমকে বলেন, ‘হাইকোর্টের রায়টি মোডিফাই করে আপিল বিভাগ কিছু নির্দেশনা দিয়েছে।’
৫৪ ধারা ও ১৬৭ ধারা প্রয়োগের েেত্র দশ দফা নীতিমালার পাশাপাশি রায়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং বিচারপতি, ট্রাইব্যুনালের বিচারক ও ম্যাজিস্ট্রেটদের প্রতি বেশকিছু নির্দেশনা রয়েছে বলে জানান তিনি।
‘গাইডলাইনে প্রথমেই বলা হয়েছে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থায় যারা আছেন, তারা যেন অতি উচ্চমানের দায়-দায়িত্ব পালন করেন। সে বিষয়ে যথাযথ সমতা তাদের দেখাতে হবে।’
‘যাকে গ্রেফতার করা হবে তাদের েেত্র যেন মানবাধিকার ুণœ না হয়। যে আসামিকে ধরা হবে তাকে যেন নির্যাতন বা হেয় প্রতিপন্ন করা না হয়।’
তবে দেশে যদি যুদ্ধ থাকে বা যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করে, জাতীয় নিরাপত্তা যদি বিঘিœত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয় অথবা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা থাকে, সেসব পরিস্থিতিকে এই রায়ে ‘ব্যতিক্রম’ হিসেবে ধরা হয়েছে বলে মুরাদ রেজা জানান। রাষ্ট্রপ এ রায়ের রিভিউ চাইবে কি না জানতে চাইলে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘রায় পুরোপুরি পর্যালোচনা, যথাযথ কর্তৃপরে সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে রিভিউয়ের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
আইন-শৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীর কর্তব্য:
১. উঁচুমানের পেশাগত দায়িত্বশীলতা দিয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা মানুষকে সুরা ও কমিউনিটিকে সেবা দেবে; নিজেদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব তারা পালন করবে আইন মেনে। ২. দায়িত্ব পালনকালে তারা মানুষের মর্যাদা রা ও সম্মান করবেন এবং মানবাধিকার সমুন্নত রাখবেন। ৩. অত্যন্ত প্রয়োজনীয় েেত্র কেবল দায়িত্ব পালনে আবশ্যক হলেই আইন-শৃঙ্খলা রাকারী বাহিনী শক্তি প্রয়োগ করবে। ৪. আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ নিষ্ঠুর-অমানবিক-মর্যাদাহানিকর কোনো আচরণ, নির্যাতন বা শাস্তিপ্রদান অথবা তাতে উস্কানি দেওয়ার ঘটনা সহ্য করবে না। ৫. সংবিধান স্বীকৃত নাগরিক অধিকারের প্রতি আইন-শৃঙ্খলা রাকারী বাহিনী কেবল সম্মানই দেখাবে না, তা মেনেও চলবে।
৬. মানুষের জীবন যেহেতু সবচেয়ে মূলবান সম্পদ, সেহেতু আইন-শৃঙ্খলা রাকারী বাহিনী মানুষের জীবন ও মর্যাদা রায় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেবে। ৭. আইন-শৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীর প্রাথমিক চেষ্টা থাকবে অপরাধের পথ বন্ধ করার দিকে। একটি অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর সক্রিয় হওয়ার চেয়ে আগেই তা প্রতিহত করা উত্তম।
গ্রেফতার-হেফাজত নীতিমালা:
১. কাউকে গ্রেফতারের পরপরই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এ বিষয়ে একটি নথি তৈরি করবেন, যেখানে গ্রেফতারের স্থান, সময় ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির স্বার থাকবে। ২. গ্রেফতারের সময় ও স্থান এবং আটক রাখার জায়গা গ্রেফতার ব্যক্তির স্বজনকে জানাতে হবে। স্বজনদের কাউকে না পেলে ব্যক্তির নির্দেশনা অনুসারে তার বন্ধুকে জানাতে হবে। আর তা করতে হবে ১২ ঘণ্টা পার হওয়ার আগেই। ৩. কোন যুক্তিতে, কার তথ্যে বা অভিযোগে ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে, ঠিকানাসহ তা কেস ডায়েরিতে লিখতে হবে। আটক ব্যক্তি কোন কর্মকর্তার তদারকিতে রয়েছেন, তাও উল্লেখ করতে হবে। ৪. গ্রেফতারের পর কাউকে রিমান্ডে নিতে হলে আগে তার বিরুদ্ধে অবশ্যই মামলা দায়ের করতে হবে। ৫. বিশেষ মতা আইনে আটক রাখার জন্য কাউকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করা যাবে না।
৬. কাউকে গ্রেফতারের সময় আইন-শৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীর সদস্যকে অবশ্যই তার পরিচয় জানাতে হবে। প্রয়োজনে পরিচয়পত্র দেখাতে হবে। ৭. গ্রেফতার ব্যক্তির শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন থাকলে চিকিৎসার জন্য তাকে নিকটবর্তী হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। সংশ্লিষ্ট ডাক্তারের কাছ থেকে সনদ নিতে হবে। ৮. ব্যক্তিকে যদি তার বাসা বা কর্মেেত্রর বাইরে অন্য কোথাও থেকে গ্রেফতার করা হয়, সেেেত্র থানায় নেওয়ার ১২ ঘণ্টার মধ্যে বিষয়টি তার স্বজনদের লিখিতভাবে জানাতে হবে। ৯. গ্রেফতার ব্যক্তি চাইলে যে কোনো স্বজনের সঙ্গে সাাৎ বা আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করার সুযোগ পাবেন। ১০. কোনো ব্যক্তিকে যখন আদালতে হাজির করা হয়, তখন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা তার ফরওয়ার্ডিং লেটারে ব্যাখ্যা করবেন- কেন ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তার পে তদন্ত শেষ করা সম্ভব না। ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগকে কেন বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে, তাও উল্লেখ করতে হবে।
বিচারকদের জন্য গাইডলাইন:
ক. আইন-শৃঙ্খলা রাকারী বাহিনী ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৭(২) ধারা অনুসারে ডায়েরির অনুলিপি ছাড়া কাউকে আদালতে হাজির করে আটকাদেশ চাইলে ম্যাজিস্ট্রেট, আদালত, ট্রাইব্যুনাল একটি বন্ড গ্রহণ করে তাকে মুক্তি দিয়ে দেবে। খ. আটক থাকা কোনো ব্যক্তিকে আইন-শৃঙ্খলা রাকারী বাহিনী অন্য কোনো সুনির্দিষ্ট মামলায় যদি গ্রেফতার দেখাতে চায়, সেেেত্র যদি ডায়েরির অনুলিপিসহ তাকে হাজির না করা হয়, তাহলে আদালত তা মঞ্জুর করবেন না। গ্রেফতার দেখানোর আবেদনের ভিত্তি না থাকলে বিচারক আবেদন খারিজ করে দেবেন। গ. উপরোক্ত শর্ত অনুসারে গ্রেফতার ব্যক্তিকে আটকের পর ১৫ দিনে মামলার তদন্ত শেষ না হলে এবং মামলাটি যদি কেবল দায়রা আদালত বা ট্রাইব্যুনালে বিচারযোগ্য হয়, সেেেত্র এ ধরনের ব্যক্তিকে ৩৪৪ ধারা অনুসারে রিমান্ডে পাঠানো যাবে, যা একবারে ১৫ দিনের বেশি হবে না।
ঘ. ফরওয়ার্ডিং লেটার এবং মামলার ডায়েরিতে কোনো ব্যক্তিকে আটক রাখার জন্য সন্তোষজনক কারণ পাওয়া গেলে বিচারক পরবর্তী বিচারিক পদেেপর আগ পর্যন্ত তাকে আটক রাখার আদেশ দিতে পারে। ঙ. সম্ভাব্য অপরাধমূলক কর্মকা- থেকে বিরত রাখার জন্য আটক করা হয়েছে- এমন সন্দেহভাজন কাউকে বিচারিক হেফাজতে পাঠানোর আবেদন বিচারক মঞ্জুর করবেন না। চ. ১৬৭ ধারায় আটক ব্যক্তিকে কোনো আদালতে হাজির করা হলে শর্তগুলো পূরণ হয়েছে কি-না, তা দেখা ম্যাজিস্ট্রেট বা বিচারকের দায়িত্ব। ছ. আইন-শৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীর কেউ যদি কাউকে আইনের বাইরে গিয়ে আটক করে থাকেন, তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট দ-বিধির ২২০ ধারায় তার বিরুদ্ধে পদপে নেবেন।
জ. হেফাজতে কারও মৃত্যু হলে বিচারক মেডিকেল বোর্ড গঠন করে মৃত ব্যক্তিকে পরীা করবেন। এমনকি দাফন হয়ে গেলেও লাশ তুলে তা করতে হবে। নিপীড়নে মৃত্যু হয়েছে বলে প্রতিবেদন পাওয়া গেলে হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন অনুসারে ওই কর্মকর্তা, সংশ্লিষ্ট থানার ওসি বা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার কমান্ডিং কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অপরাধ আমলে নিতে হবে। ঝ. মেডিকেল প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে নির্যাতনের ফলে হেফাজতে মৃত্যু বা নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে বলে প্রতীয়মান হলে বিচারক স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে অপরাধ আমলে নেবেন; মামলা দায়েরের অপো করবেন না।