ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সের চূড়ান্ত রায়ে জেলা জজদের পদমর্যাদা সচিবদের সমান রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় স্পিকারের সমতূল্য প্রধান বিচারপতি
মাহমুদুল আলম ও এস এম নূর মোহাম্মদ : ১৯৭৫ সালে রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদাক্রমে (ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স) স্পিকার ও প্রধান বিচারপতির পদ এক সঙ্গে ৪ নম্বরে ছিল। সে সময় ২ নম্বরে ভাইস প্রেসিডেন্টের এবং ৩ নম্বরে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছিল। কিন্তু ভাইস প্রেসিডেন্টের পদ উঠে যাওয়ায় ২ নম্বরে প্রধানমন্ত্রীকে নেওয়া হয়েছে। ৩ নম্বরে স্পিকারকে নেওয়া হয়েছে। প্রধান বিচারপতিকে ৪ নম্বরে রেখে তার পদমর্যাদার অবনমন করা হয়েছে। তাই প্রধান বিচারপতির পদটি স্পিকারের সঙ্গে রাখতে বলা হলো। প্রধান বিচারপতিকে জাতীয় সংসদের স্পিকারের সমমর্যাদায় রাখার কারণ হিসেবে এই পর্যবেক্ষণ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।
দেশের রাষ্ট্রীয় মর্যাদার ক্রমবিন্যাস নির্ধারণ করে দেয়া রায়ে এই আদেশ দিয়েছে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। গতকাল এ সংক্রান্ত পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করে সুপ্রিম কোর্ট। রায়ে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেলকে হাইকোর্টের বিচারপতির পদমর্যাদায় এবং হাইকোর্টের বিচারপতিদেরকে প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় স্থান দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। রায়ে বলা হয়, সংবিধান যেহেতু রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন, সেহেতু রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদাক্রমের শুরুতেই সাংবিধানিক পদাধিকারীদের গুরুত্বানুসারে রাখতে হবে।
রায়ে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা ও অস্ট্রেলিয়ার রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদাক্রম তালিকাও তুলে ধরা হয়। রায়ে বলা হয়, ওইসব দেশের রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদাক্রম তালিকা বাংলাদেশ থেকে আলাদা।
সাংবিধানিক পদাধিকারীদের সবার উপরে রেখে এবং জেলা জজ ও সচিবদের মর্যাদা সমান করে রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদাক্রম সংশোধনের চূড়ান্ত এই রায় প্রকাশ করা হয়। গতকাল সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে ৬২ পৃষ্ঠার এ রায় প্রকাশিত হয়। আপিল বিভাগের দেয়া এই রায়টির মূল অংশ লিখেছেন সাবেক প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন। তার সঙ্গে রয়েছেন বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিন্হা (বর্তমান প্রধান বিচারপতি), বিচারপতি মো: আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দীন চৌধুরী।
হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপরে করা আপিল নিষ্পত্তি করে গত বছরের ৬ জানুয়ারি এ রায় দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির আপিল বেঞ্চ। রায়ে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের পদক্রমে স্বাধীনতা পদক, একুশে পদক এবং খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদেরও যথাযথভাবে অন্তর্ভুক্ত করা সমীচীন বলে রায়ে প্রত্যাশা ব্যক্ত করা হয়েছে। রায়ে বলা হয়, ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্ট এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের মধ্যে সমান মর্যাদা প্রতিফলিত হয়।
আপিল বিভাগের বিচারপতিদের তালিকার ৭ নম্বরে এবং আট নম্বরে হাইকোর্টের বিচারপতিদের রাখতে বলা হয়েছে। এ তালিকার ১২ নম্বরে সংসদ সদস্য এবং অডিটর জেনারেল ও ন্যায়পালকে, ১৫ নম্বরে পিএসসি চেয়ারম্যানকে রাখতে বলা হয়েছে।
জেলা জজ ও সমমর্যাদার বিচার বিভাগীয় সদস্যদের রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদাক্রমের ২৪ নম্বর থেকে ১৬ নম্বরে সরকারের সচিবদের সমমর্যাদায় রাখতে বলা হয়। কারণ হিসেবে বলা হয়, জেলা জজ পদটি জুডিশিয়াল সার্ভিসের সর্বোচ্চ পদ। একজন বিচারক ২০ বছরের আগে এ পদটিতে আসীন হতে পারেন না। তবে জেলা জজদের পদক্রম কোনোভাবেই প্রতিরা বিভাগের প্রধানদের উপরে হতে পারে না। তাদের সচিবদের সমমর্যাদায় রাখতে হবে। এছাড়া একজন জেলা জজকে যখন সংবিধানের ৯৫(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী হাইকোর্টের বিচারপতি নিয়োগ করা হয় তখন তার পদক্রম হচ্ছে ৯ নম্বরে। এভাবে সংবিধানে উল্লেখিত জেলা জজদের রাখাটা অবমাননামূলক ও লজ্জাজনক। অতিরিক্ত জেলা জজ ও সমমর্যাদার বিচার বিভাগীয় সদস্যদের রাখা হয়েছে জেলা জজদের ঠিক পরেই, রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদাক্রমের ১৭ নম্বরে।
এর আগে ১৯৮৬ সালের ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০০৬ সালে বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের তৎকালীন মহাসচিব মো. আতাউর রহমান একটি রিট দায়ের করেছিলেন। এতে শুনানি করে ওই সময় জেলা জজদের পদমর্যাদা সচিবদের নিচে দেখানো কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না- তা জানতে চেয়ে রুল জারি করে হাকোর্ট। ওই রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি রায় দেন আদালত। রায়ে আটটি নির্দেশনা দেওয়া হয়। সে অনুসারে নতুন তালিকা তৈরি করতে সরকারকে ৬০ দিন সময়ও বেধে দেন আদালত। পরে ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে রাষ্ট্রপ। আপিল নিষ্পত্তি করে কিছু সংশোধনী ও পর্যবেক্ষণ দেয় আপিল বিভাগ। গতকাল যার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হলো।
আপিল বিভাগে রাষ্ট্রপে এ মামলায় শুনানি করেন আইনজীবী আব্দুর রব চৌধুরী। হাইকোর্টে রিট আবেদনকারীর পে ছিলেন সাবেক আইনমন্ত্রী আব্দুল মতিন খসরু, ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ ও মো. আসাদুজ্জামান। সম্পাদনা: আজাদ হোসেন সুমন