বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের ভবিষ্যৎ কী?
ডা. মো. তাজুল ইসলাম
বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাটি
রুখবে জঙ্গি রুখবে চাপাতি
এককথায় বললে সব জমিতে সব ফসল ফলান যায় না। বাংলার মাটিও ‘জঙ্গি ফসল’ উৎপাদন ও এর স্থায়ী বিস্তৃতির জন্য কোনোভাবেই অনুকূল নয়। এ দেশের মানুষ জাতিগতভাবেই উগ্রতা, সহিংসতা, কট্টরতার বিরুদ্ধে। আতিথেয়তা, উদারতা, সম্প্রীতির বন্ধন এ দেশের মানুষের জাত চরিত্র। ভাববাদী, মানবতাবাদী, সুফিবাদী দর্শন যে দেশের মানুষের রক্তে মিশে আছে, সে দেশে মানুষ কুপিয়ে হত্যার হোলি খেলা বেশিদিন চালানো সম্ভব নয়।
একাত্তরের পর আবারও জঙ্গি ‘জঙ্গল’ ইস্যুতে জাতি এক হয়েছে। সর্বস্তরে এই জাতীয় ঐক্যমত তৈরি হয়েছে। এমনকি কোনো ইসলামি দল বা গোষ্ঠী এর পক্ষে নেই (একাত্তরে অন্তত কিছু ইসলামি দল বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল)। সমগ্র জাতি যখন কোনো বিষয়ে একাট্টা হয়ে দাঁড়ায়, তখন সেটিকে পরাজিত করা সময়ের ব্যাপার মাত্র।
যেসব হতভাগ্য জঙ্গি মারা গেছে, তাদের মা-বাবা তাদের লাশ নিতেও অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। তারা সন্তানদের অপকর্মের জন্য জাতির কাছে ক্ষমাও চেয়েছেন। দেশের কোনো এলাকায়, এমনকি নিজ পরিবারে যাদের স্থান হয় না, কোনোভাবেই সে ভুল মতাদর্শ এ দেশের মাটিতে শেকড় গাড়তে পারবে না। এটি শুধু আমার আশাবাদ নয়, এটিই বাস্তবতা।
জঙ্গিবাদের (বর্তমানের আইএস) গডফাদার ও মাঠ পর্যায়ের জঙ্গি কি একই উদ্দেশ্য, লক্ষ্যের? নাকি একটি ইসলামবিরোধী শক্তি (বিশেষ করে ইসরাইল) এ উগ্রতা, নিষ্ঠুরতাকে পিছন থেকে মদদ দিচ্ছে? নাকি এটি একটি ককটেল/মিশ্র জাতীয় গোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে। যেখানে মুসলিম জাতীয়তাবাদী শক্তি, স্থানীয় জাতীয়তাবাদ, স্থানীয় গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব, এমনকি স্থানীয় রাজনৈতিক ইস্যুগুলোও জড়িত হয়ে একটি ককটেল জাতীয় সংস্থায় রূপ নিয়েছে? এ সবই স্পেকুলেশন বা হাইপোথেসিস। প্রকৃত ঘটনা খুব একটা স্পষ্ট নয়। তবে কিছু বিবেচ্য বিষয় রয়েছে।
মনে আছে, আফগানিস্তানে সোভিয়েত রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যখন মুসলিম জাতীয়তাবাদীরা যুদ্ধে নামে, তখন আমেরিকাসহ পশ্চিমা শক্তি এর পিছনে মদদ দিয়েছিল? এরা কি ইসলামি জিহাদকে আদর্শ মেনে তা করেছিল? আফগান মুজাহিদরা কি জানত তাদের অস্ত্র, অর্থ কোথা থেকে আসছে? ওই সময়ে যদি ইসলাম বিরোধী শক্তি ‘ইসলামি জিহাদকে’ নিজ স্বার্থে ব্যবহার করার উদাহরণ থাকে তাহলে বর্তমানে ইসরাইলের মতো অপশক্তি মুসলমান ও মুসলিম বিশ্বকে সারাবিশ্বের সামনে অশান্তির ধর্ম, নিষ্ঠুর-হিংসায় পূর্ণ ধর্ম, মানবতাবিরোধী, সভ্যতা-সংস্কৃতিবিরোধী ধর্ম বলে চিহ্নিত করতে এর পিছনে মদদ দিলে আশ্চর্য হওয়ার কী আছে?
লক্ষণীয়, যারাই বা যে রাষ্ট্রগুলো ইসরাইলের বিপক্ষে অবস্থান নেয়, আইএস বেছে বেছে সেখানেই বেশি হামলা করে (পাশ্চাত্যের বিশ্লেষকরাই এমন দাবি করছেন)। সবচেয়ে কাছের দেশ ইসরাইলে একটি আক্রমণও করেননি, অথচ মুসলিম বিশ্ব মনে করে, ইসরাইল ইসলামের সবচেয়ে বড় শত্রু (এর মানে এই নয় যে, আমরা চাই এ রকম হত্যাযজ্ঞ সেখানেও চালানো হোক)। শুধু সন্দেহ করার কারণ হিসেবে অনেকে তেমনটি ভাবছেন বলে মনে হয়। তাছাড়া অপরাধ বিজ্ঞানের ভাষায় কোনো ঘটনার বেনিফিসিয়ারি যারা অপরাধের জন্য তাদের দিকে ইঙ্গিত করা হয়।
আইএস জঙ্গিদের বিভৎস্য হত্যাকা- শুধু ইসলামবিরোধী নয়, এটি ইসলামকে কালিমা লিপ্ত করে। এতে বেনেফিসিয়ারি কি মুসলমানরা হচ্ছে? বদনামের ভাগিদার হওয়া ছাড়াও এদের কুকর্মের জন্য পুরো বিশ্ব মুসলমানদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে, প্রতি পদে বাধা পাচ্ছে, সব সুযোগ বন্ধ হয়ে গেছে।
বেশির ভাগ উগ্র জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থান ঘটেছে স্থানীয় গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব, স্থানীয় জাতীয়তাবাদী চেতনা থেকে। আইএসের মূলশক্তি সাদ্দামের প্রাক্তন সৈনিকরা। রয়েছে শিয়া, সুন্নিসহ ভূ-রাজনৈতিক অনেক সমীকরণ। এর সঙ্গে কোনো কোনো দেশের স্থানীয় রাজনীতিও স্বার্থান্বেষী মহল এর ভিতর ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। সব মিলিয়ে ককটেলটা ভালোই মিশেল পেয়েছে বললে কি বাড়িয়ে বলা হবে? তবে এ সবই অনুমানভিত্তিক হাইপোথেসিস, প্রামাণ্য নয়। (পুরো বিষয়টি বিতর্ক সাপেক্ষ। তাই ভিন্নমতের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। আমরা প্রকৃত সত্য জানার অপেক্ষায়…)। তবে বিভিন্ন দেশ থেকে যে সব মুসলিম তরুণ সেখানে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যোগদান করছে তাদের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য স্পষ্ট, তাদের মনস্বত্ব ভিন্ন।
লেখক: লেখক: অধ্যাপক ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা।
সম্পাদনা: আশিক রহমান