চীনা বাঁদর, মুম্বাইয়ের যজ্ঞ, মার্কিন নির্বাচন এবং আমরা
কাকন রেজা
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট
চীনা বাঁদরের ভবিষ্যদ্বাণী ফলে গেছে। ট্রাম্প জিতেছেন। মার্কিন নির্বাচনের আগে মার্কিন মুল্লুকে প্রবাসী কয়েকজন ভারতীয় ব্যবসায়ী ভারতের সিনেমা শহর মুম্বাইয়ে একটি মন্দিরে পূজার ‘যজ্ঞ’ আয়োজন করেছিলেন। ‘যজ্ঞ’টি ছিল ট্রাম্পের জয়ের জন্য। তাদের সে ‘যজ্ঞ’ও কাজে লেগে গিয়েছে।
চিনা ‘বাঁদর’ এবং মুম্বাইয়ের ‘যজ্ঞ’ যেন সকল হিসাব-নিকাশ উলটপালট করে দিয়েছে। এত জরিপ, এত বিশ্লেষণ সব যেন পরাজিত ‘বাঁদর’ আর ‘যজ্ঞে’র কাছে। বিশ্বের সব প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যমও হতবিহ্বল, হিলারির এমন সম্ভাবনা প্রাবল্যে কীভাবে জয়ী হলেন ট্রাম্প এমন ভাবনায়। মার্কিন নির্বাচন ঘিরে এবার সবচেয়ে বেশি আগ্রহ ছিল বিশ্ববাসীর এবং তা নানা কারণেই। আর আমরা তো জাতি হিসেবে এমনিতেই কৌতুহলি। তাই আমাদের আতিশয্যটা বেশিই ছিল।
নির্বাচনে অনেকেই বাজি ধরেছিলেন হিলারির পক্ষে। সেই কাতারে আমাদের অনেক প্রবাসীও ছিলেন। তারা হেরেছেন। নানা জরিপ দেখে মার্কিনিদের মন বোঝার চেষ্টা করেছিলেন তারা। তার উপর মার্কিন মুল্লুকে তাদের অবস্থানও হয়তো তাদের নিজ ভাবনাকে অগ্রগামী করেছিল। কিন্তু জরিপে কিংবা মার্কিন মুল্লুকে থাকলেই কী আর মার্কিনিদের মন বোঝা যায়! যায় না।
ট্রাম্প যে জিতবেন তা কিন্তু কেউ কেউ ভেবেছিলেন। হয়তো হিলারি প্রাবল্যে তারা মুখ খুলতে চাননি। কিংবা খুললেই বিপরীত প্রচারণার স্রোতে তাদের কথা হারিয়ে গেছে। বাংলাদেশি প্রবাসীর প্রায় সবাই হিলারির জয় চেয়েছিলেন। প্রবাস থেকে পাঠানো মন্তব্য ও লেখায় অন্তত তাই মনে হয়েছে।
কিন্তু আমার প্রথমেই খটকা লেগেছিল মার্কিন মুল্লুক থেকে পাঠানো একজন বাংলাভাষী হিন্দু কম্যুনিটির নেতার লেখায়। দেশের একটি প্রথম শ্রেণির নিউজ পোর্টালে তার লেখাটি পড়েছিলাম। তখন অন্যান্যদের মতো প্রচার প্রাবল্যে লেখাটিকে ব্যক্তিগত সমর্থন প্রভাবিত বলেই মনে হয়েছিল। কিন্তু তারপরও মনের খটকাটুকু কিন্তু যায়নি। মার্কিন নির্বাচন নিয়ে নানা লেখা পড়েছি। আমিও লিখেছিলাম। কিন্তু একটা লেখার পরেই আর নিজে লিখতে মন সায় দেয়নি। কারণ সেই ভদ্রলোকের লেখা। নির্বাচনের পরে যা অনেকেই বুঝেছেন তা তিনি বুঝেছিলেন নির্বাচনের অনেক আগেই। এটা কী দূরদর্শিতা না অন্যকিছু।
মার্কিন নির্বাচন নিয়ে ছোট মাথায় খুব বেশি ব্যথাও ছিল না। কারণ যুক্তরাষ্ট্রে কে প্রেসিডেন্ট হলেন তা নিয়ে আমাদের তেমন বেশি কিছু আসে যায় না। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে নির্বাচনে মোদির জয়লাভের পর দেশের অনেকেই উল্লসিত হয়েছিলেন। মোদির জয়ে গদির আশায় আশান্বিত হয়েছিলেন। কিন্তু আখেরে ফলাফলটা কী? যাহা কদু তাহাই লাউ।
যদিও একবার বলা তবুও গল্পটি আবার বলি। ‘এক সিনেমা পাগল একটি সিনেমা ষোলবার দেখেছেন। তাকে এতবার দেখার কারণ জিজ্ঞাসা করার পর বললেন, সিনেমার এক জায়গায় নায়িকা নদীর তীরে কাপড় খুলছিলেন গোসল করার জন্য, এ সময় নদীর পার্শ্ব দিয়ে যাওয়া লাইনে একটি ট্রেন চলে আসায় কাপড় খোলার পুরো দৃশ্যটা দেখা সম্ভব হয়নি। তাকে আবার প্রশ্ন করা হলো, তাতে কী! এতে সিনেমাটি ষোলবার দেখার কী আছে?
সিনেমা পাগল প্রশ্নের উত্তরে বলল, যদি একবার ট্রেনটি লেট করতÑ তাহলে তো।’ এমন ‘তাহলে তো’র বিষয়টি মনে হয় দেশের অনেকের মাথায়ই ভর করেছে। সিনেমার ট্রেনের যেমন ‘লেট’ হওয়া সম্ভব নয়, তেমনি পরের দৃশ্য দেখার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য মার্কিন বা ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতির পরিবর্তনও সহসা সম্ভব নয়।
আমাদের দেশে ব্যক্তিগত সম্পর্কের মূল্য আর মার্কিনিদের ব্যক্তিগত সম্পর্কের মূল্যের মধ্যে অনেক ফারাক। আমরা ব্যক্তিগত সম্পর্কের সূত্র ধরে অনেকসময় অনেক কিছুর পরিবর্তন ঘটাই, এমনকি তা কোনো ক্ষেত্রে আমাদের স্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলেও। এখানেই মার্কিন কিংবা ভারতীয়দের সঙ্গে আমাদের পার্থক্য। তারা ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে নিজ দেশের স্বার্থে একচুল ছাড় দিতেও নারাজ। রাষ্ট্রীয় স্বার্থের প্রয়োজনে তারা প্রবল শত্রুর সঙ্গে মিত্রতা করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করবে না, করে না। তাদের রাষ্ট্রীয় স্বার্থে আবেগের কোনো জায়গা নেই। জায়গা থাকলে মার্কিন ও ভারতের সামরিক চুক্তি সম্ভব হতো না। সম্ভব হতো না রাশিয়া পাকিস্তানের যৌথ সামরিক মহড়াও।
সুতরাং মার্কিনে ক্ষমতায় কে আসলো কিংবা ভারতে কে বসলেন অথবা ব্রিটেনের নতুন প্রধানমন্ত্রী কোন ধারার হবেন এসব না ভেবে নিজ নিজ কর্মকৌশল ঠিক করাই আমাদের দায়িত্বশীলদের মূল কাজ হওয়াই উচিত।
মার্কিন নির্বাচন নিয়ে যোগাযোগ মাধ্যম সরগরম। হার-জিতের কারণের ‘অকারণ’ বিশ্লেষণ, হতাশা, উল্লাস ইত্যাদি সব প্রাবল্যে পুরা সয়লাব সামাজিক ও গণমাধ্যমগুলোর নিউজফিড। ট্রাম্পের জয়ের পাঁচ কারণ, হিলারির পরাজয়ের দশ দিক, এ ধরনের লেখা মাধ্যমগুলোতে তাকালেই দেখা যায়। কিন্তু যারা মার্কিনি চরিত্র আঁচ করতে পারেন তাদের এসব লেখা টানে না, টানার কথাও নয়। তারা জানে, মার্কিনিরা বোঝে কীসে তাদের ভালো। মার্কিনিরা জানে, তাদের দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা মন্দার দিকে। তারা জানে, তাদের বেকার সমস্যা উদ্বেগজনক। তারা বোঝে, সারাবিশ্বে ‘অর্থনৈতিক’ স্বার্থে মুসলমানদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক খুব ভালো যাচ্ছে না। সুতরাং তারা তাদের ভাবনা ভেবেছে।
ট্রাম্পের অভিবাসনবিরোধী মনোভাব, মুসলিমবিদ্বেষ ছিল অধিকাংশ আমেরিকানদের মনের কথা। তারা নিজেদের ক্রমবর্ধমান সমস্যা বাড়াতে অভিবাসীদের জায়গা দিতে রাজি নয়, যেহেতু মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ তাদের ভালো চোখে দেখে না তাই মুসলিমদের ব্যাপারেও তারা কঠোর। আর ট্রাম্প সেই কথাই বলেছেন। আর তাই তিনি এখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট।
এদেশে যারা প্রশ্নবোধক ‘উদারনীতি’ সমর্থন করেন তাদের জন্য হয়তো বিষয়টি একটু গোলমেলে। যারা নিজের ‘ধরম’ চেয়ে পরের ‘ধরম’ আঁকড়ে ধরাটাকে আবশ্যিক মনে করেন, বাঁকাভাবে বলতে পরস্ত্রীর প্রতি যাদের আকর্ষণ কিছুটা বেশি, তাদের কাছে বিষয়টি সত্যিকারার্থেই গোলমেলে। কিন্তু আমেরিকানরা তাদের নিজ দিকটাই দেখেছেন। তারা কোনো গোলমেলে ধারণার মধ্যে নেই। মার্কিনিরা তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস আর রাষ্ট্রীয় চেতনার কথাই ভেবেছেন, অন্যকিছু নয়। আর মার্কিনিদের উন্নতির মূলমন্ত্রই এই বিশ্বাস ও চেতনা। তাদের এই বিশ্বাস আর চেতনার মূলমন্ত্র থেকে আমাদের অনেক কিছুই শেখার আছে এবং শেখা উচিত।
পুনশ্চ: ট্রাম্প জেতার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক ‘সেক্যুলার’ দাবিদারদের চাপা উল্লাস এবং হিলারির পরাজয়ে এদেশে কারা ধরাশায়ী হবেন এমন ভেবে অনেক ‘নারীবাদী’দের আত্মতৃপ্তি অন্তত দুটি বিষয়কে আমাদের সামনে পরিষ্কার করেছে। সঙ্গে ট্রাম্পের জয়ে এদের উল্লাস ও আত্মতৃপ্তির আধিক্যে ‘তৃপ্তি’ উড়ে গিয়ে নিজ ‘আত্ম’টা উন্মোচিত হয়ে পড়েছে প্রবলভাবে।
সুতরাং আমাদের যারা এতদিন ‘সেক্যুলার’ ‘নারীবাদ’ এসব শব্দের আবহে এমন অনেকের প্রতি মোহাক্রান্ত ছিলেন তাদের নতুন করে ভেবে দেখার সময় এবং সুযোগ এসেছে।
সম্পাদনা: আশিক রহমান