হুমায়ূন আহমেদ : কোথাও কেউ নাইতেও আছেন আপনি
অজয় দাশগুপ্ত
আমাদের কথা সাহিত্যে তার মতো জনপ্রিয় লেখক দ্বিতীয় কেউ নেই। এমনও বলা হয়, শরৎচন্দ্রের পর তিনিই বাঙালি বেস্ট সেলার লেখক। গোগ্রাসে গিলেছে পাঠক তাকে। এটা খুব সহজ কিছু না। ষোল কোটি মানুষের দেশ আমাদের। এখানে নাম করা এত সহজ কিছু না। কতজন যে কতভাবে চেষ্টা করছে পারছে না। যারা তার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছিল তারাই তার কড়া সমালোচক। পিছিয়ে পড়া এরাই তার বিরুদ্ধে বলেছেন আজীবন। এমনকি মৃত্যুর পরও তাকে রেহাই দেয়নি তারা। আমি খুব বিশ্বাসের সঙ্গে বলি, তার মৃত্যুর পর শহীদ মিনারে যত মানুষের ভিড় হয়েছিল, দূরদূরান্ত থেকে ছুটে এসেছিল, তার সিকিভাগ মানুষও এদের জন্য যাবেন বলে মনে হয় না। কারও জনপ্রিয়তা নিয়ে কটু কথা বলা বা সন্দেহ পোষণ করা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি শুধু বলছি, এই সোনা ফলানো মানুষটিকেও কেউ ছাড় দেয়নি।
পশ্চিমবঙ্গের লেখকরা আমাদের দেশে সবসময় মাথার ওপর থাকেন। রাজনৈতিক দোলাচলের কমতি শান্ত জীবন আর অতীতের উত্তরাধিকারে তাদের লেখার জগত বিচিত্র আর বর্ণাঢ্য। সে তুলনায় আমাদের জীবন অশান্ত। নিজেদের স্বাধীনতা মাটি ও জীবনের প্রতি একশ্রেণির মানুষের বিরুদ্ধাচারণ ও মারামারির কারণে আমরা ভালো করে নিঃশ্বাসও নিতে পারি না। সে দেশে, সে সমাজে একজন মানুষ একটি চরিত্র দিয়ে সকলের মনযোগ কেড়ে নিয়েছিলেন। সেই হিমু চরিত্রটি আজ কিংবদন্তি। কে জানে হয়তো এর ভিতরেই লুকিয়ে আছে তারুণ্যের ভালোবাসা। আছে হিন্দু-মুসলমানের মিলিতরূপ। হয়তো সে কারণেই তার নাম হিমু। যাতে তিনি হাত দিয়েছেন সেটাই হয়েছে স্বার্থক। তার মতো করে নাটক নির্মাণ করতে পেরেছেন কজন? মুক্তিযুদ্ধ থেকে আলকা আসির নাটক সর্বত্রগামী এক অসামান্য প্রতিভা। শেষের দিকে ঝিমধরা বা গতানুগতিক নাটকগুলো তার সুনামের সঙ্গে যায় না। এমনকি লেখাও। তাই বলে সেটাই চূড়ান্ত বিবেচনা হতে পারে না। এই মানুষটি আমাদের দুহাত ভরে দিয়েছেন। জীবনের শুরুতে দিয়েছেন অসাধারণ দুটি উপন্যাস। একেবারে শেষে এসে আমি নামের যে বইটি দিয়েছেন তার ভিতর মেধা ও জীবন একসঙ্গে কাজ করেছে। প্রায় প্রতিদিন এই গ্রন্থটি আমাকে নাড়া দিয়ে যায়।
সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের জীবনে বিদেশি লেখকদের প্রভাব কমিয়ে আমাদের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে দেওয়া মানুষটির জীবন নিয়েও কম আগ্রহ নেই আমাদের। তার দ্বিতীয় বিবাহ জীবনকে আনন্দ দিয়েছে কিনা জানি না, তবে বিষিয়ে তুলতেও দ্বিধা করেনি। তাকে এমন এক জায়গায় ঠেলে দেওয়া হয়েছিল, যেখানে নিজের কল্পিতভূবন ছাড়া আসলে ছিলেন অসহায়। তারপরও তাকে আমরা ভুলিনি। তাকে ভোলেননি পাঠক। সারাদেশে এমন প্রিয়তা পাওয়া মানুষটি দুম করেই চলে গিয়েছিলেন। গানও লিখতেন। একটা গানে বলেছিলেন, চাদনী পসর রাতে যেন আমার মরণ হয়। দেশে মারা যাননি। আমেরিকায় শেষ নিঃশ্বাস যাবার সময় জোসনা ছিল কিনা জানি না। তবে সারাজীবন জোসনা পাগল মানুষটির তিরোধানে মনজোসনার ডালি খুলে দিয়েছিল বাংলাদেশের মানুষ।
আজ তার জন্মদিনে তাকে আমরা আবার মনে করি। হুমায়ূন আহমেদ আপনি আছেন। আপনি বেঁচে থাকবেন। যখন কোথাও কেউ নেই, তখনো আপনি আছেন।
লেখক: সিডনি প্রবাসী, কলামিস্ট ও বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষক
সম্পাদনা: আশিক রহমান