অপেক্ষায় ‘আছে-নাই’
কিযী তাহ্নিন লেখক: কলামিস্ট
‘না ই’-এর উপর আমি মহাবিরক্ত। এতটাই বিরক্ত যে নিজের অজান্তে কপাল কুঁচকে যাচ্ছে আমার। সেটা বুঝতে পেরে কপাল টানটান সোজা করছি, চোখের আয়তন স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছি। কিন্তু লাভ হচ্ছে না, খানিকপর আবারও কপাল কুঁচকাচ্ছে, সেই সঙ্গে ভুরু জোড়াও।
বেয়াদব ধরনের মানুষ ‘নাই’। বড় হতে হতে ও হয়ে উঠবে উদ্ধত, ওর আচরণ সে রকমই জানান দিচ্ছে। আসলে ওকে দোষ দিয়ে কি লাভ, যেমন পরিবেশে বড় হচ্ছে ও, তাতে আদব-লেহাজ শিখবে এই আশা করা কি ঠিক? তারপরেও, আমি তো তার চেয়ে বয়সে বড়। সেই সঙ্গে ওকে যথেষ্ট পাত্তা দিই। এমন বেয়াদবি আচরণ না করলেও পারত।
হয়েছে কি, আমি গেছিলাম পাশের রাস্তায় বই ফটোকপি করাতে। ফটোকপিতে সময় লাগবে দেখে, মামুন ভাইয়ের দোকানে যেয়ে সর্ষের তেল আর নতুন আলু মেশানো গরুর তেহারি খেয়েছি। চা খেয়েছি। শেষে একটা পানও খেয়েছি। তারপর দোকানে যেয়ে দেখি, তখনও ফটোকপি হয়নি। মেশিনে গ-গোল। কাল এসে বই নিতে হবে। এত কাছে এসেছি যখন, ক্যাম্পাসেই চলে যাই। এ ভেবেই আসা। সঙ্গে ‘নাই’ এর সঙ্গে খানিক সময় কাটানোর ইচ্ছেও ছিল। মাঠের যেখানটায় সবসময় বসি, সেখানে বসে দেখছিলাম বা ভাবছিলাম কিংবা অনুভব করছিলাম। বাতাসে শীতের গন্ধ। বিকেলগুলো যেন সন্ধ্যে হবে বলেই শুধু দেখা দিচ্ছে, যেমন তেমন করে। শীতের বিকেলগুলো ভারি অলস। নিজের রূপ সম্পর্কে মোটেও সচেতন না। বরং দ্রুত সন্ধ্যায় লুকাতে পারলেই বাঁচে।
আচ্ছা, আমি এত কথা বলছি কেন? মেজাজটা বিক্ষিপ্ত বলে হয়তো। মূল ঘটনায় আসি বরং, বসে আছি সামান্য কিছুক্ষণ। এর মাঝে দেখি, ‘নাই’ সাহেব তার চেয়ে লম্বায় আধা ইঞ্চি ছোট আরেকজনের সঙ্গে গল্প করছে। বাপরে, কি সেই গল্প। আমার সঙ্গে গল্প করলে, আমিই প্রায় সব কথা বলি, সে চুপ করে তার বালুর পা নাচায়, নয়তো জামার বের হয়ে থাকা সুতা টানাটানি করে।
আজ সে আড্ডার মুরব্বি বলে, কথার ফুলঝুরি ফোটাচ্ছে। বাহ্ বাহ্ এবং আমাকে না দেখার ভান করছে। আমি নিশ্চিত সে আমাকে দেখেছে। না দেখার কোনো কারণ নেই। কারণ সে মাঠের ডান দিকে, ছোটজনকে নিয়ে আমার মুখোমুখি বসে আছে। ছোটজনের চেহারা দেখে মায়া লাগছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে ‘নাই’ এর কথায় খুব বিরক্ত হচ্ছে। ছোট মানুষ। কিছু বোধহয় বলতেও পারছে না। আচার-ব্যবহারও ভালো পিচ্চির। ‘নাই’ এর মতোন না। বিরক্ত হলেও সে বিরক্তিভাব লুকিয়ে রেখে, পা ছড়িয়ে বসে ‘বালুর পা’ ওয়ালার কথা শুনছে। পা নাচাচ্ছে না, সুতা টানাটানি নেই, মাথা চুলকানো নেই।
‘নাই’ বোধহয় আমার উপর প্রতিশোধ নিচ্ছে। মাঝে একদিন ‘নাই’ এর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। সে গল্প লেখা হয়নি। কারণ সেদিন আমি এসেছিলাম আমার বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে। ‘নাই’কে সামনে পেয়ে, ‘কিরে নাই, আছিস কেমন?’ বলে ওর মাথার চুলগুলো নেড়ে দিয়েছিলাম। সেদিন বেশি কথা বলিনি দেখে, সে বোধহয় প্রতিশোধ নিচ্ছে। কিন্তু আমি তো সেদিন কথা বলেছিলাম। তার মতোন এমন অভদ্র আচরণ তো করিনি। তাকিয়ে দেখি, সে এখন ওই পিচ্চির দিকে তাকিয়ে আছে। পিচ্চি তাকে কি যেন বলছে হাত নেড়ে নেড়ে। বলতে বলতে পিচ্চি উঠে গেল। বুঝলাম, পিচ্চি ‘নাই’ এর সঙ্গে গল্প করতে ইচ্ছুক না তেমন। কথা বলতে বলতেই প্রায় হাত নেড়ে চলে গেল পিচ্চি।
আমি তাকিয়ে আছি সামনের দিকে। যাতে ‘নাই’ বুঝতে না পারে যে আমি তাদের দেখছিলাম। আহা, আড়চোখে তাকিয়ে দেখি, এই যে ‘নাই’ আসছে আমার দিকে হেঁটে হেঁটে। জানতাম যে সে আমাকে লক্ষ্য করেছিল। কেমন স্বার্থপর, পিচ্চি বিদায় হয়েছে, এখন আমাকে জ্বালাতে আসছে। এতক্ষণ তো চিনতেই পারেনি। আমি মুখ যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে সামনে তাকিয়ে থাকলাম। কিন্তু আমার কপালের ভাঁজ বড্ড বেয়াড়াপনা করছে আজকে, বারবার কুঁচকে যাচ্ছে। ‘নাই’ আমার পাশে এসে বসেছে, দাঁতের ফাঁকে আটকে রেখেছে লম্বা ঘাসের ডগা। কি বিশ্রী অভ্যাস, ঘাস খাচ্ছে।
সামনে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমি ঘাসে দুপা মেলে ডানে বামে নাড়াচ্ছি। অন্যদিন ‘নাই’ পা নাচায়, আজ আমি নাচাচ্ছি। আমি ভালো অভিনেতা নই, আমার বিরক্তিভাব যাতে প্রকাশ না পায়, তাই অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে সে ভাব ঢাকার চেষ্টা করছি। ‘এইডা আমার বন্ধু।’ আমার পাশে বসে আমার দিকে তাকিয়ে বলে সে। ‘নাই’ এর কথা শুনে পাশে তার দিকে তাকাই। অন্যদিন আমি কথা শুরু করি, আজ সে শুরু করেছে। আমি আজকে তার কথার উত্তর দিলাম না। ‘নাই’ দেখি নিজে নিজেই কথা চালিয়ে যাচ্ছে, ‘ওর আসলে একটা বিপদ হইসে।’
আমি এবার একটু ঘুরে বসি, একটু হালকা হাসি পাচ্ছে। কেন পাচ্ছে বুঝছি না। বলি, ‘এই আধা ইঞ্চি পিচ্চির কি বিপদ?’ ‘মানুষ মাত্রই বিপদ থাকে।’ ‘নাই’ শীতল গলায় উত্তর দেয়। এইটা যে ‘নাই’ এবং সে যেকোনো প্রশ্নের উত্তরে ফিলোসফি কপচাবে, তা তো আমার জানা। তাই কথার প্রসঙ্গ ঘুরাই, ‘কি বিপদ?’ ‘বলা যাবে না, ও মানা করছে বলতে।’ ‘নাই’ এর পরণে সেই পুরনো ডিমের কুসুম রঙের ফতুয়া, তার বোতাম ঘরের সাদা সুতো টানতে টানতে উত্তর দেয়। ‘ও আচ্ছা, তা তুই সমাধান দিলি?’ ‘হ, সমাধান দিছি, ও এখন একখানে গেছে। সেখানে গেলে কাজ হয়ে যাবে।’
‘বাহ্ বাহ্, তুই তো বিশাল কাজের মানুষ রে, তো তুই সঙ্গে গেলি না যে?’ ‘নাহ, ও একা গেলেই হবে। ফিরে এসে আমাকে জানাবে।’ ‘হু, তুই বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করছিস তাইলে?’ ‘নাই’ আজকে একদিনে অনেক কথা বলে ফেলেছে। তাই মনে হয় এ কথার উত্তর আর সে দিল না। চিবানো ঘাসের ডগাটা হাতে নিয়ে বসে আছে।
আমার কেন যেন খুব আনন্দ হচ্ছে। বুঝতে পারছি ধীরে ধীরে ‘নাই’ এর জন্য পুরনো মায়া ফিরে আসছে। ওর বোতাম টানাটানি, বালুর পা নাচানাচিকে বেয়াদবি মনে হচ্ছে না। ‘নাই’ তার বন্ধুর বিপদের সমাধান দেবার বিশ্বস্ত একজন মানুষ বলে, নাকি বন্ধুর কাছ থেকে আমার কাছে ফিরে এলো বলে এত আনন্দ হচ্ছে, বুঝতে পারছি না।
এ শহরের শীত বড্ড অপেক্ষা করায়। বিকেল শেষের শহরটিকে মনে হচ্ছে, কুয়াশার সামিয়ানায় ঢাকা এক মঞ্চ। এক্ষুনি ঢোল মাদল বাজিয়ে শীত তার আসর শুরু করবে। আয়োজন শেষ, মঞ্চ তৈরি, কিন্তু আসর শুরু হচ্ছে না এখনো। আমি অপেক্ষা করছি। ‘নাই’ হয়তো তার বন্ধুর ফেরার অপেক্ষা করছে, কিংবা ‘শীতের’ ফিরে আসার। তার অস্থির চোখ জোড়ায় অপেক্ষার গল্প লেখা আছে। গল্পের শেষটুকু আমি জানি না। কিন্তু সে অপেক্ষা করছে, এটুকু জানি। ‘আছি’ আর ‘নাই’ মিলে শীতের ফিরে আসবার উৎসবের, কিংবা বন্ধুর ফিরে আসবার সেই সময়ের অপেক্ষা করছি।
সম্পাদনা: আশিক রহমান