‘মালাউন’ শব্দের প্রয়োগ-অপপ্রয়োগ এবং ব্যথিতজনের হৃদয়কথন
ড. নিমাই মন্ডল
আমাদের কথার মধ্যে আমরা বহু শব্দ ব্যবহার করি। এর সবই যে আমরা চিন্তা-ভাবনা করে উচ্চারণ করি তা নয়। কোনো শব্দ সচেতনভাবে, কোনো শব্দ অসচেতনভাবে, আবার কোনো শব্দ অবচেতন বা অর্ধচেতনভাবে আমরা প্রয়োগ করি আমাদের সংলাপে। শব্দ ব্যবহারে কখনো যে কেউ অপমানিত বা ব্যথিত হচ্ছেÑ এটা হয়তো তখন আমরা অনুধাবন করতে পারি না। আমাদের সমগ্র চিন্তা-চেতনা, কর্মপ্রবাহ এবং জীবনধারার পরিপন্থি কোনো শব্দ ব্যবহারের পরপরই বা পরবর্তী কোনো সময়ে আমরা অনুতপ্ত হই, লজ্জা পাই, বিবেকের দংশনে জর্জরিত হই। এমনি একটা শব্দ ‘মালাউন’। এই শব্দটির প্রয়োগ, প্রয়োগকারীর দৃষ্টিভঙ্গি এবং সার্বিক পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে এর শাব্দিক অর্থ বদলে গিয়ে অন্য অর্থ এবং মনোভঙ্গিই এখন প্রকট হয়ে উঠেছে।
‘মালাউন’ শব্দটি সম্পর্কে আলোচনার পূর্বে প্রাসঙ্গিক কিছু কথা জেনে নেওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার গোটা বিশেক অভিধান ঘেটে ‘মালাউন’ শব্দটি পাওয়া গেছে মাত্র ৩টি অভিধানে। বলাবাহুল্য, এর সবগুলো অভিধানই বাংলাদেশ থেকে, আরও সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে বলতে হয়, বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত। আমার জানা মতে, বাংলা ভাষার প্রথম দিকের কোনো অভিধান থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত পশ্চিম বাংলা থেকে প্রকাশিত কোনো বাংলা ভাষার অভিধানেই ‘মালাউন’ শব্দটি নেই। তাদের ব্যবহারিক জীবনে শব্দটির তেমন প্রয়োগ নেই বলেই হয়তো তাদের অভিধানেও শব্দটি স্থান পায়নি। কিন্তু আমাদের দেশে ‘মালাউন’ শব্দটির বহুল প্রয়োগ এবং অপপ্রয়োগ শব্দটিকে করেছে তাৎপর্যপূর্ণ এবং গুরুত্বের সঙ্গে স্থান দিয়েছে অভিধানের পাতায়।
‘মালাউন’ শব্দটি এসেছে আরবি ভাষা থেকে। এদেশে ‘মালাউন’ শব্দটির ব্যবহার অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, ১৯৪৭-এ ভারত বিভাগের পর থেকে আমাদের দেশের কিছু মানুষের মুখে ‘মালাউন’ শব্দটির ব্যবহার দ্রুতহারে বাড়তে থাকে। এর আগেও শব্দটির ব্যবহার ছিল, তবে তা ছিল অনুল্লেখযোগ্য কিন্তু যথাযথ। বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের কবিতায় এবং আধুনিক যুগের কারও কারও সাহিত্যকর্মে ‘মালাউন’ শব্দটি লক্ষ্য করা যায়। পাকিস্তান সৃষ্টির পর বেশিরভাগ উর্দুভাষী পাকিস্তানি হিন্দু শব্দের পরিবর্তে ‘মালাউন’ শব্দটি ব্যবহার করতে থাকে। এই অপব্যবহারের ব্যাপকতা চোখে পড়ে ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়। সে সময় হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় সহযোগিরা ব্যাপকভাবে ‘মালাউন’ শব্দটি ব্যবহার করতে থাকে। হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর কোনো সদস্য হিন্দুদেরকে কখনো ‘হিন্দু’ সম্বোধন করেছে এমন উদাহরণ বিরল। মুক্তিযুদ্ধের সময় তারা মুক্তিবাহিনীর সদস্য এবং তাদের ভাষায় মালাউনদের খোঁজ করত, হিন্দুদেরকে নয়। ‘মালাউন’ শব্দটি এরা বৌদ্ধ বা খ্রিস্টানদের প্রতি নয়; শুধু হিন্দুদের প্রতি ব্যঙ্গার্থে বা তুচ্ছার্থে বা চরম ঘৃণা প্রকাশার্থে ব্যবহার করতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশে মননে পাকিস্তানি কিছু সাম্প্রদায়িক মানুষ হিন্দুদেরকে শুধু ‘মালাউন’ই নয়; আরও ঘৃণার্থে ‘মালাউন’ শব্দটিকে তাদের মানসিকতার মতো বিকৃত করে ‘মালোয়ান’ এবং কোথাও তীব্রতম ঘৃণা ও ঈর্ষার প্রকাশ ঘটিয়ে ‘মালোয়ান’ শব্দকে সংক্ষিপ্ত করে ‘মালু’ শব্দটি চালু করেছে, যা একজন সামান্যতম হৃদয়বান ও ব্যক্তিত্ববান মানুষকে ব্যথিত না করে পারে না।
‘মালাউন’ শব্দটির অর্থ নিরূপণে অভিধানের শরণাপন্ন হওয়া যাক। প্রখ্যাত ভাষাতাত্ত্বিক, প-িত ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সম্পাদিত ‘বাংলা একাডেমি বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান’-এ ‘মালাউন’ শব্দটির প্রথম অর্থ দেওয়া হয়েছে ‘বিধর্মী’ এবং দ্বিতীয় অর্থ ‘অভিশপ্ত’। কাজী রফিকুল হক সম্পাদিত বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘বাংলা ভাষায় আরবি-ফারসি-তুর্কি-হিন্দি-উর্দু শব্দের অভিধান’ গ্রন্থে ‘মালাউন’ শব্দটিকে প্রথমত ‘মালউন’ বানানে দেওয়া হয়েছে, যার আরবি উচ্চারণ নির্ধারণ করা হয়েছে ‘মল্’ঊন’ এবং শব্দটির প্রথম অর্থ দেওয়া হয়েছে ‘অভিশপ্ত’; ‘বিতাড়িত’ এবং দ্বিতীয় অর্থ দেওয়া হয়েছে ‘শয়তান’। আর ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক এবং শিবপ্রসন্ন লাহিড়ী সম্পাদিত ‘বাংলা একাডেমি ব্যবহারিক বাংলা অভিধান’ গ্রন্থে ‘মালাউন’ শব্দটির প্রথম অর্থ দেওয়া হয়েছে লানতপ্রাপ্ত; অভিশপ্ত; বিতাড়িত; কাফের (উদ্ধৃতি: অনাচারে কার সরদার মুসলিম অভিমানে ছাড়িয়ে গেল চিরতরে মালাউনকেÑ শাহাদাত হোসেন), দ্বিতীয় অর্থ দেওয়া হয়েছে ‘শয়তান’, আর তৃতীয় অর্থ দেওয়া হয়েছে, মুসলমানকর্তৃক ভিন্ন সম্প্রদায়ের লোককে দেওয়া গালিবিশেষ। এই অভিধানের অন্যত্র ‘মালাউন’ শব্দের ‘লানতপ্রাপ্ত’ অর্থে ‘লানত’ বা ‘লানৎ’ আরবি শব্দটির দুটি অর্থ দেওয়া আছে। প্রথমটি ‘অভিশাপ’ (উদ্ধৃতি: হাজার লানত যে এমন কাজ করেÑ সৈয়দ হামজা)। দ্বিতীয় অর্থ ‘অপমান’; ‘লাঞ্ছনা’; ‘ভর্ৎসনা’। তৃতীয় অর্থ ‘শাস্তি’ (উদ্ধৃতি: সে সবেরে লাহানতি দিবেক আল্লায়Ñ সৈয়দ সুলতান)। অর্থাৎ অভিধানের আলোকে ‘মালাউন’ শব্দটির অর্থ ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহকৃত অর্থ ‘বিধর্মী’র মধ্যেই আজ আর সীমাবদ্ধ নেই। আজ অন্যকোনো ধর্মাবলম্বীকে না বুঝিয়ে ‘মালাউন’ শব্দটির অর্থ সংকুচিত করে বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধিবিশিষ্ট কিছু মানুষ শুধু হিন্দুদেরকেই ‘মালাউন’ নামে অভিহিত করছে। শব্দটির অর্থ যদি ‘বিধর্মী’ অর্থাৎ অন্য ধর্মাবলম্বীকে বোঝাত তাহলেও কথা ছিল। কিন্তু বর্তমানে ইসলাম ধর্মাবলম্বী ব্যতীত অন্যকোনো ধর্মাশ্রয়ীকে নয়; সুনির্দিষ্টভাবে তারা ‘মালাউন’ শব্দ দিয়ে শুধু হিন্দুদেরকেই বোঝাচ্ছে। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ‘মালাউন’ শব্দটির প্রথম অর্থ ‘বিধর্মী’ জানালেও দ্বিতীয় অর্থ দিয়েছেন ‘অভিশপ্ত’। উল্লেখ্য, শহীদুল্লাহ ব্যতীত আর কোনো অভিধানকার শব্দটির অর্থ ‘বিধর্মী’ বলেননি। অন্যদের অভিধানে যে অর্থটি গুরুত্ব পেয়েছে সেটি হচ্ছে ‘অভিশপ্ত’ এবং ‘বিতাড়িত’। তাহলে কি ওইসব সাম্প্রদায়িকমনস্ক ব্যক্তির কথায় ধরে নেব, এদেশের হিন্দুরা অভিশপ্ত এবং বিতাড়িত? অভিশপ্ত হলে কখন, কোথায়, কীভাবে, কার দ্বারা অভিশপ্ত হলো; আর বিতাড়িত হলে কোন জায়গা থেকে, কখন তাদেরকে তাড়িয়ে দেওয়া হলো। এদেশের হিন্দুরা কি নিচ মনোভাবাপন্ন ওইসব ব্যক্তিকর্তৃক অভিশাপগ্রস্ত হলো এবং এই হিন্দুরা কি নিজ বাসভূম থেকে বিতাড়িত হলো? না। বাংলাদেশের হিন্দুরা বাংলাদেশের মাটির সন্তান। এদেশে ইসলাম প্রচারের কয়েক সহস্র বছর আগে থেকে তারা এখানে আছে এবং ইসলাম প্রচারের পর থেকে হিন্দু ও মুসলমান ধর্মের অনুসারী সাধারণ মানুষ একে অন্যের সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে হাত ধরাধরি করে ভাই-ভাইয়ের মতো অংশগ্রহণ করে সুখে-শান্তিতে বসবাস করছে। ধর্ম পালন যার যার ব্যক্তিগত হলেও তখন থেকেই ধর্মীয় উৎসবটা হয়ে উঠেছে সবার। সুতরাং ‘অভিশপ্ত’ বা ‘বিতাড়িত’-র মতো নিকৃষ্ট অর্থে হিন্দুদেরকে নয়; বরং ওই সাম্প্রদায়িক মনোভাবদুষ্ট সংকীর্ণ মানুষদেরকেই উল্টো ‘মালাউন’ অভিধায় চিহ্নিত করা যেতে পারে। কাজী রফিকুল হকের অভিধানে ‘মালাউন’ শব্দের অর্থ দেওয়া হয়েছে আরবি শব্দ ‘শয়তান’, যার অর্থ আল্লাহদ্রোহী ফেরেশতা, পাপাত্মা, অতিশয় দুর্বৃত্ত, বদমায়েশ ইত্যাদি। তবে কি এদেশের হিন্দুরা আজ ওই মানুষদের কাছে এসব নেতিবাচক বিশেষণের উপযুক্ত? নিশ্চয়ই নয়। আর ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হকের অভিধানে ‘মালাউন’ শব্দের আর একটি উল্লেখযোগ্য অর্থ দেওয়া হয়েছে, ‘কাফের’ (আরবি শব্দ কাফির), যার অর্থ সত্য প্রত্যাখ্যানকারী, ইসলামধর্ম অস্বীকারকারী, ইসলামবিরোধী ইত্যাদি।
লেখক: খ-কালীন শিক্ষক, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
সম্পাদনা: আশিক রহমান