একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প ও টেকসই বিতর্ক
খুরশীদ আলম
দারিদ্র্য দূর করে দেশকে ২০২১ সালের মধ্যে একটি মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে নিয়ে যাওয়ার গুরুত্বপূর্ণ যে কাজটি তা হলোÑ কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির বর্তমান ধারা ধরে রেখে গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রার মানের একটি গুণগত উত্তরণ নিশ্চিত করা। পাশাপাশি শিল্পায়ন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, শিক্ষা এইসব খাতগুলোকেও অগ্রাধিকার দিতে হবে। তবে যেহেতু দেশের মোট জিডিপির ৫১ ভাগ এখনো আসছে কৃষি অর্থাৎ গ্রামীন অর্থনীতির খাত থেকে। তাই কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে গ্রামীণ জনগণের কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রচেষ্টা বাদ দিয়ে বা পাশ কাটিয়ে কোনোভাবেই দারিদ্র্য ও ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ অর্জন চিন্তা করা যায় না। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক নেওয়া দ্বি-স্তর সমবায় পদ্ধতির মাধ্যমে গৃহীত ‘সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচি’র ধারাবাহিকতায় ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। এই প্রকল্পটি প্রথম ১৯৯৮ সনে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হসিনা কর্তৃক হাতে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। কিন্তু ২০০১ সনে সরকার পরিবর্তনের পর প্রথম এই প্রকল্পটির উপর আঘাত আসে। ‘পল্লী প্রগতি প্রকল্প’ নামে একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয় এবং ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পটির বিলুপ্তি ঘটিয়ে প্রকল্পের তহবিলসহ সকল সম্পদ ‘পল্লী প্রগতি প্রকল্পে’ হস্তান্তর করা হয়। প্রকল্পে বাস্তবায়ন এলাকা সীমিত করে প্রতিটি উপজেলায় একটি মাত্র ইউনিয়নকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং উন্নয়ন কর্মকা-কে গ্রাম থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়। এই পদক্ষেপ থেকে এটা স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে, ‘পল্লী প্রগতি প্রকল্প’টি গ্রাম উন্নয়ন বান্ধব কোনো প্রকল্প ছিল না। তারপর ২০০৯ সনে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হসিনার দারিদ্র্যবিমোচন ও গ্রাম উন্নয়ন বান্ধব সরকার ক্ষমতায় আসার পর পুনরায় ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্প হাতে নেয়। তারপর থেকে ২০১৬ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত দুটি পর্যায়ে প্রকল্পটির বাস্তবায়নের কাজ চলেছে। প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায় শেষ হওয়ার পর স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের অধীন পল্লী উন্নয়ন সমবায় বিভাগকর্তৃক প্রকল্পের তৃতীয় পর্যায়ের প্রকল্প প্রস্তাবনা দাখিল করেছে। অপরদিকে প্রকল্পটির দ্বিতীয় পর্যায় শেষ হবার পর ‘পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক’ নামে একটি বিশেষায়িত ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে দ্বিতীয় পর্যায়ের মেয়াদ শেষ হওয়া ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পের সকল তহবিল ও সম্পদ এবং দায়দেনা এই পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকে হস্তান্তর করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বিষয়টা নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের অধীন পল্লী উন্নয়ন সমবায় বিভাগের মধ্যে বেশ টানাপোড়েন চলছে এবং কিছু পত্র-পত্রিকায় বিষয়টি নিয়ে লেখালেখিও হচ্ছে।
বর্তমান নিবন্ধটি গ্রাম উন্নয়ন ও দারিদ্র্র্যবিমোচন বান্ধব একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের টেকসই-এর প্রশ্নটি নিয়ে লেখার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা মাত্র। প্রবন্ধটি লেখার জন্য আমার স্বল্পকালীন সময়ের জন্য একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পে এবং পল্লী প্রগতি প্রকল্পে কাজ করার অভিজ্ঞতা, প্রকল্প প্রস্তাবনাসমূহ, বাস্তবায়ন নির্দেশিকাসমূহ এবং সর্বোপরি বিষয়টি নিয়ে কয়েকটি পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনসমূহ, সর্বোপরি পল্লী উন্নয়ন বিষয়ে নিজের কিছু প্রকাশিত প্রবন্ধ তথ্যসূত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। বর্তমান প্রবন্ধটিতে তিনটি ধাপ রয়েছে। প্রথম ধাপে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকর্তৃক প্রদত্ত কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশ সাধনের লক্ষ্যে গৃহীত কর্মকা- এবং ভবিষ্যতের জন্য দিকনির্দেশনা গুলোর বিশ্লেষণ ও বর্তমান সময় পর্যন্ত তা থেকে অর্জনের একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা। দ্বিতীয় ধাপে বঙ্গবন্ধুকন্যা, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হসিনা কর্তৃক গৃহীত রূপকল্প-২০২১ এবং রূপকল্প-২০৪১ নির্ধারণ এবং অর্জনের লক্ষ্যে গ্রামীণ অর্থনীতিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পের কর্মকা- বিশ্লেষণ এবং শেষ ধাপে একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প ও গঠিত পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক-এর মধ্যে যে তাত্ত্বিক দ্বান্দ্বিকতা রয়েছে এবং তর্ক-বিতর্ক চলছে তা বিশ্লেষণ করে রূপকল্প-২০২১ এবং রূপকল্প-২০৪১ অর্জন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সুপারিশ উপস্থাপন করা।
পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচিÑ ১৯৭২-১৯৮০ : এ যাবৎ পল্লী উন্নয়ন সেক্টরে যে সকল পরিবর্তন ঘটেছে এবং এখনো পরিবর্তন ঘটে যাছে তার সবই হচ্ছে দ্বি-স্তর সমবায়ের মাধ্যমে পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচির প্রভাব থেকে বা অভিজ্ঞতা থেকে। এই অর্জনটা কিন্তু জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর দেখা অনেকগুলো স্বপ্নের মধ্যে ুধামুক্ত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নের বাস্তবায়ন। তিনি স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিলেন, ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীকে (বর্তমানের দ্বিগুন হয়ে যাওয়া) খাওয়াতে হলে এমন সব পদপে নিতে হবে যার মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলের জনগণের আর্থ-সামাজিক অবস্থার একটা গুণগত পরিবর্তন ঘটে। তাই ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে পল্লীর জনগণের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনের ল্েয তিনি দুটি যুগান্তকারী পদপে নিয়েছিলেন।
প্রথমত, কৃষি গ্রাজুয়েটদেরকে সরকারি চাকরিতে তিনি প্রথম শ্রেণির মর্যাদা দিয়ে গেছেন। তিনি স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিলেন, বর্ধিত জনগোষ্ঠীকে খাওয়াতে হলে উৎপাদন বাড়াতে হবে। আর উৎপাদন বাড়াতে হলে নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে হবে। এর জন্য দ কৃষি বিজ্ঞানী গড়ে তুলতে হবে। সুতরাং কৃষি গ্রাজুয়েটদেরকে মর্যাদার আসনে না বসালে এই সেক্টরে মেধার সমাবেশ ঘটবে না। আর মেধার সমাবেশ না ঘটাতে পারলে উন্নত প্রযুক্তিরও উদ্ভাবন সম্ভব হবে না। বর্তমানে উন্নতজাতের ধান বীজসহ বিভিন্ন ধরনের প্রধান ও অপ্রধান শস্যের বীজ উদ্ভাবিত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। উন্নত ফসল উৎপাদন কৌশল আবিষ্কৃত হচ্ছে এর সবই বঙ্গবন্ধুর দেখা স্বপ্নের ফসল। (চলবে…)
লেখক: কৃষিবিদ, প্রাক্তন যুগ্ম-পরিচালক, বিআরডিবি
সম্পাদনা: আশিক রহমান