একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প ও টেকসই বিতর্ক
খুরশীদ আলম
দ্বিতীয়ত, কৃষকদের মাঝে এই সমস্ত উদ্ভাবিত নতুন নতুন প্রযুক্তিগুলো পৌঁছে দেওয়ার জন্য তৎকালীন সময়ে কৃষি বিভাগকর্তৃক পরিচালিত সম্প্রসারণ কৌশল (টিএন্ডভি পদ্ধতি) কাজ হচ্ছিল না বিধায় তৃণমূল পর্যায়ে কৃষকদের সংগঠন গড়ে তুলে উদ্বুদ্ধকরণসহ নতুন প্রযুক্তিগুলো ব্যবহারের কৌশল পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে কুমিল্লা মডেলের সর্বশেষ কম্পোনেন্ট অর্থাৎ দ্বি-স্তর সমবায় পদ্ধতির বাস্তবায়নের জন্য আইআরডিপি অর্থাৎ সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছিলেন। এই কর্মসূচির মাধ্যমেই পল্লী উন্নয়নের প্রচেষ্টাকে বাস্তবে রূপ দিতে সক্ষম হয়েছিলেন।
দ্বি-স্তর সমবায়ভিত্তিক সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচি: বাস্তবায়ন কৌশল কি ছিল?
প্রথম ধাপে আইআরডিপির মাধ্যমে গ্রামের ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদেরকে সংগঠিত করে গ্রাম পর্যায়ে সমবায় সমিতি গঠন করা হয়। দ্বিতীয় ধাপে সংগঠিত সমবায় সমিতিগুলোকে সমবায় বিভাগকর্তৃক নিবন্ধন করার মাধ্যমে কৃষকদের সংগঠনগুলো সরকারের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত হয়। তৃতীয় ধাপে নিবন্ধিত সমবায় সমিতিগুলো থানা/উপজেলা পর্যায়ে তাদের কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতি গঠন করে। এই কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতির অফিসে প্রতিমাসে প্রাথমিক সমবায় সমিতির প্রতিনিধিগণ (সভাপতি/ম্যানেজার/আদর্শ কৃষক) একত্রিত হয়ে এবং নিজেদের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য আলোচনায় অংশগ্রহণ করে। যাকে মাসিক প্রশিক্ষণ বলা হতো। কৃষি বিভাগসহ থানা/উপজেলা দপ্তরের অন্যান্য জাতি গঠনমূলক সংস্থাগুলো মাসিক প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে উদ্ভাবিত/নতুন প্রযুক্তিগুলো নিয়ে হাজির হতো এবং ব্যবহারের কলাকৌশল শিখিয়ে দিত। চতুর্থ ধাপে কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন উন্নত প্রযুক্তিগুলো সংগ্রহ/বিদেশ খেকে আমদানি করে ভর্তুকি মূল্যে কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতিগুলোর মাধ্যমে সমবায়ী কৃষকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া নিশ্চিত করত। পঞ্চম ধাপে সমবায় সমিতি গুলোকর্তৃক চাহিদাকৃত প্রযুক্তি সংগ্রহের অর্থের যোগান দিত রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালি ব্যাংক। এই পদ্ধতিতে অর্থাৎ সমন্বিত পদ্ধতিতে কাজ করার ফলে ৮০ দশকের শেষ দিকে এসে দেশ সধৎমরহধষষু খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে সক্ষম হয় ।
সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচির ধারাবাহিকতা: ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্প
৯০-এর দশকের শুরু থেকে এই সমন্বিত পল্লী উন্নয় কার্যক্রমটি ভেঙে পড়ে। তারপর ১৯৯৬ সনে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় আসে তখন কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে গ্রামীণ উন্নয়নের লক্ষ্যে ‘একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প’ হাতে নেওয়া হলো। অবশ্যই প্রকল্পটি বঙ্গবন্ধুকর্তৃক গৃহীত সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচিরই বর্তমান চাহিদার সম্প্রসারিত সংস্করণ। কিন্তু ২০০১ সালে সরকার পরিবর্তনের পর প্রকল্পটি মুখ থুবড়ে পড়ে যায়। কারণ ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পটি বিলুপ্ত করে ‘পল্লী প্রগতি প্রকল্প’ নামে একটি প্রকল্প চালু করা হয় এবং ইতোমধ্যে উপজেলা দপ্তরগুলোতে ছাড়কৃত তহবিলসহ দপ্তরের আসবাবপত্র ‘পল্লী প্রগতি প্রকল্পে’ হস্তান্তর করা হয়। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি যে, ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পটি ছিল ১৯৭২ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকর্তৃক গৃহীত ‘সমন্বিত পল্লী উন্নয় কর্মসূচি’র একটি সম্প্রসারিত সংস্করণ, যা গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। যাইহোক, ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত গ্রামীণ জনগণের উন্নয়নের জন্য উল্লেখযোগ্য কোনো কর্মসূচি বা প্রকল্প দেখা যায় না। তবে ১৯৯৮ সালে নেওয়া ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পটিকে অবলুপ্ত করে গ্রাম থেকে উঠে এসে ইউনিয়ন পর্যায়ে সীমাবদ্ধ রাখা হলো এবং প্রতিটি উপজেলায় একটি মাত্র ইউনিয়নকে এই প্রকল্পের আওতায় রাখা হলো। এই পদক্ষেপ থেকে এটা স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে, পল্লী প্রগতি প্রকল্পটি গ্রাম উন্নয়ন বান্ধব কোনো প্রকল্প ছিল না।
তারপর ২০০৯ সালে দারিদ্র্যবিমোচন ও গ্রাম উন্নয়ন বান্ধব সরকার ক্ষমতায় আসার পর পুনরায় ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্প হাতে নেয়। এই প্রকল্পের মধ্য দিয়ে গ্রামের প্রত্যেকটি পরিবারকে এক একটি উৎপাদনমুখি ও আয় বর্ধনমূলক অর্থনৈতিক কর্মকা-ের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করার লক্ষ্য স্থির করা হয়। প্রকল্পের এই একটি মাত্র লক্ষ্যকে অর্জন করা সম্ভব হলে বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে যে পরিবর্তন আসবেÑ
ক. গ্রামের প্রতিটি বাড়িকে একেকটি উন্নতমানের সমন্বিত কৃষি খামারে উত্তরণ ঘটানো হবে। খ. প্রত্যেকটি বাড়ি গ্রামীণ অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হবে। গ. স্ব-কর্ম সৃষ্টি করা সম্ভব হবে। ঘ. বাড়তি উৎপাদন বিক্রির জন্য বিপণন ব্যবস্থা বৃদ্ধি পাবে। ফলে বর্ধিত লোকবলের প্রয়োজন হবে। বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি সম্ভব হবে। ঙ. সর্বোপরি বর্ধিত শষ্য ও কৃষি উৎপাদন নিশ্চিত হবে এবং কেউ কর্মহীন থাকবে না।
পত্রিকায় প্রকাশিত এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধুকন্যা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকর্তৃক দেওয়া দিকনির্দেশনার ভিত্তিতে প্রকল্প গৃহীত হলেও পরবর্তী পর্যায়ে প্রকল্পটিতে কিছু ডেভিয়েশন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। প্রকল্পটির যে মূল থিম অর্থাৎ গ্রামের প্রতিটি কৃষক পরিবারকে এক একটি কৃষিভিত্তিক উৎপাদনমুখি খামারে পরিণত করা। সেক্ষেত্রে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি এবং টেকসই পরিবেশবান্ধব কৃষিব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রযুক্তি হস্তান্তরের কোনো কার্যক্রম থাকেনি। কেবল সম্পদ হস্তান্তর, সঞ্চয় জমা, ম্যাচিং তহবিল প্রদান, প্রশিক্ষণ এবং ঋণ প্রদান যা পূর্বের নেওয়া প্রকল্পগুলোর মতোই গতানুগতিক।
লেখক: কৃষিবিদ, প্রাক্তন যুগ্ম-পরিচালক, বিআরডিবি
সম্পাদনা: আশিক রহমান