মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা নিজ থেকে সম্পূর্ণ নয়
ইকতেদার আহমেদ
‘মুক্তিযোদ্ধা’ শব্দটি একটি উপাধি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে যাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অবদান ছিল তাদের অনেককে এ উপাধিটি দেওয়া হলেও ৮ নভেম্বর, ২০১৬ খ্রি. পূর্ববর্তী এ শব্দটি সংজ্ঞায়িত হয়নি। উক্ত তারিখে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক জারিকৃত প্রজ্ঞাপন অবলোকনে দেখা যায়, মুক্তিযোদ্ধা শব্দটির সংজ্ঞায়ন করতে গিয়ে বলা হয়, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণায় সাড়া দিয়ে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ হতে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে যে সকল ব্যক্তি বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন তারাই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য হবেন’।
প্রজ্ঞাপনটিতে আরও বলা হয়, এদের মধ্যে যে সমস্ত ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য বাংলাদেশের সীমানা অতিক্রম করে ভারতের বিভিন্ন ট্রেনিং বা প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে নাম অন্তর্ভুক্ত করেছেন, যে সকল বাংলাদেশি পেশাজীবী মুক্তিযুদ্ধের সময় বিদেশে অবস্থানকালে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশেষ অবদান রেখেছেন এবং যে সকল বাংলাদেশি বিশিষ্ট নাগরিক বিশ্বে জনমত গঠনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন, যারা মুক্তিযুদ্ধকালীন গঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের (মুজিবনগর সরকার) অধীনে কর্মকর্তা বা কর্মচারি হিসেবে দায়িত্বপালন করেছেন, সশস্ত্রবাহিনী, পুলিশ, ইপিআর, আনসারবাহিনীর সদস্য যারা মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের (মুজিবনগর সরকার) সঙ্গে সম্পৃক্ত এমএনএগণ ও এমপিএগণ (গণপরিষদ সদস্য),পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী ও তাদের সহযোগী কর্তৃক নির্যাতিত নারীগণ (বীরাঙ্গনা), স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী ও কলাকুশলীবৃন্দ এবং দেশ ও দেশের বাহিরে দায়িত্বপালনকারী বাংলাদেশি সাংবাদিকগণ, স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের খেলোয়াড়বৃন্দ, মুক্তিযুদ্ধকালে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা প্রদানকারী মেডিকেল টিমের ডাক্তার, নার্স ও সহকারিবৃন্দ রয়েছেন।
দেশের বিভিন্ন পেশাজীবী যেমন আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সাংবাদিক এর সংজ্ঞা আইন দ্বারা নির্ধারিত, অনুরূপ প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত বিভিন্ন পদধারী যেমনÑ সচিব, জেলা জজ, জেলা প্রশাসক প্রভৃতির সংজ্ঞাও আইন দ্বারা নির্ধারিত। যখন যেকোনো পেশাজীবী বা পদধারীর সংজ্ঞা আইন দ্বারা নির্ধারিত হয়, তখন প্রয়োজনীয় যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি ছাড়া অপর কারও সংজ্ঞাভুক্ত হওয়ার সুযোগ থাকে না।
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনী বিভিন্ন জেলা ও মহাকুমা শহরের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ পরবর্তী সেনা, ইপিআর, পুলিশ, আনসার এবং ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক জনতার একটি অংশ ভারতে পাড়ি জমান। ভারতে অবস্থানকালীন ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক জনতার অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তি সকলকে অনধিক দুমাসের প্রশিক্ষণ দিয়ে বিভিন্ন ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত করে দেশের অভ্যন্তরে গেরিলা যুদ্ধ চালানোর নিমিত্তে প্রেরণ করা স্বাধীনতা অর্জন অবধি অব্যাহত থাকে।
গেরিলা যুদ্ধ বলতে বোঝায়, অনিয়মিত খ- যুদ্ধ। আর গেরিলা যোদ্ধা হচ্ছেন, খ- যুদ্ধে নিযুক্ত ব্যক্তি অথবা নিয়মিত বাহিনীর বিরুদ্ধে অনিয়মিত খ- যুদ্ধে লিপ্ত রাজনৈতিক দলের সদস্য। নিয়মিত বা প্রচলিত যুদ্ধের (ঈড়হাবহঃরড়হধষ ধিৎভধৎব) সঙ্গে গেরিলা যুদ্ধের (এঁবৎরষষধ ধিৎভধৎব) পার্থক্য হচ্ছেÑ প্রথমোক্ত যুদ্ধটি এক বা একাধিক স্বাধীন ও স্বীকৃত রাষ্ট্রের সরাসরি ও নিয়মিত যুদ্ধ। অপরদিকে শেষোক্ত যুদ্ধটি হচ্ছেÑ স্বাধীন ও স্বীকৃত রাষ্ট্রের নিয়মিত বাহিনীর সঙ্গে স্বাধীনতা বা মুক্তি সংগ্রামরত অনিয়মিত বাহিনীর খ-িত যুদ্ধ। তাছাড়া নিয়মিত ও অনিয়মিত বাহিনীর পার্থক্য হচ্ছেÑ নিয়মিত বাহিনীর সকল সদস্যই পেশাদার এবং জীবন ও জীবিকার তাগিদে নিয়মিত বাহিনীতে তাদের অন্তর্ভুক্তি পক্ষান্তরে বিভিন্ন পেশা ও কর্মজীবীর সমন্বয়ে একটি বিশেষ উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হাসিলের অভিপ্রায়ে অনিয়মিত বাহিনীর গঠন এবং লক্ষ্য অর্জন সমাপ্ত হলে এর বিলুপ্তির মাধ্যমে কার্যক্রমের অবসান।
বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় মুক্তিযুদ্ধের ভূমিকা অনন্য, অম্লান ও অবিস্মরণীয়। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি এ দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সর্বাত্মক সমর্থন ছিল। এ সর্বাত্মক সমর্থনকে অবলম্বন করে মুক্তিযুদ্ধের কৌশল নির্ধারণের ক্ষেত্রে গেরিলা যুদ্ধ পদ্ধতিটি বেছে নেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের এ দেশের গ্রামীণ জনসাধারণ অকৃত্রিম ও হৃদয় নিংড়ানো স্নেহ ও ভালোবাসায় আবদ্ধ রাখতে গিয়ে নিজেদের জানমালের নিরাপত্তাকে তুচ্ছ ভেবে সম্মিলিতভাবে সকল প্রকার সাহায্যের হাত প্রশস্ত করেছিল। তারা যে শুধু খাদ্য, পথ্য, তথ্য, বস্ত্র, আশ্রয় ও অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছিল তা নয় বরং অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, নিজেদের ঘুম ও আরামকে বিসর্জন দিয়ে রাতভর মুক্তিযোদ্ধাদের পাহারা দিয়ে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছিল। এমন হাজারো দুঃখজনক ও বিয়োগান্তক ঘটনা আজও আমাদের বিবেকবোধকে তাড়িত করে চলছে যখন আমরা জানতে পারি, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রস্থান পরবর্তী পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগিরা মুক্তিযোদ্ধাদের না পেয়ে ক্রোধের জ্বালা নিবারণার্থে নৃশংসভাবে আশ্রয়দাতা গ্রামবাসীদের হত্যা করে বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দিয়ে পরিবারগুলোকে মহা বিপর্যয়ে নিপতিত করেছিল।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ৪৪ বছর অতিক্রান্ত হলেও ৮ নভেম্বর, ২০১৬ খ্রি. পূর্ববর্তী ‘মুক্তিযোদ্ধা’ শব্দটি কোনো আইন দ্বারা সংজ্ঞায়িত না হওয়ায় এর বহুবিধ ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। অনেকের মতে, যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় অস্ত্রধারণ করে শত্রুর মোকাবিলা করেছিলেন একমাত্র তারাই মুক্তিযোদ্ধা। আবার অনেকের মতে, মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করেছিলেন তারা মুক্তিযোদ্ধা। আবার অনেকের মতে, মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা দেশের অভ্যন্তরে প্রশিক্ষণ নিয়ে অভ্যন্তরীণভাবে অস্ত্র সংগ্রহ করে প্রতিরোধ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন তারাই মুক্তিযোদ্ধা। আবার অনেকে বলেন, অস্ত্রধারী মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি যারা যুদ্ধকালীন তাদের খাদ্য, পথ্য, তথ্য, বস্ত্র, আশ্রয় ও অর্থ দিয়ে সাহায্য করে হয়রানি ও ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন তারাও মুক্তিযোদ্ধা, আবার অনেকে বলেন, শান্তি কমিটি, রাজাকার, আল বদর ও আল শামস বাহিনীর সদস্য হিসেবে যারা পাকিস্তানিবাহিনীর সহায়তা করেছেন তারা ছাড়া অপর সকলে মুক্তিযোদ্ধা।
যদিও মুক্তিযুদ্ধে দেশের একটি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী ব্যতীত অপর সকলের নিরবিচ্ছিন্ন সমর্থন ছিল কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী দেখা গেল যারা জেনারেল এমএজি ওসমানি, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, শেখ ফজলুল হক মনি ও সিরাজুল আলম খান স্বাক্ষরিত সনদ সংগ্রহ করতে পেরেছেন একমাত্র তারাই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত হয়ে তালিকাভুক্ত হয়েছেন। এরশাদের শাসনামলে সনদপ্রাপ্ত সকল মুক্তিযোদ্ধার সনদ জমা দেওয়ার নির্দেশ প্রদানপূর্বক প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে নানাবিধ যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা পুনঃ প্রস্তুতের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ তালিকায় অনেক সংযোজন ও বিয়োজন হয়। পরবর্তীতে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ শাসনামলে যে সব তালিকা প্রস্তুত হয় তাতেও অনেক সংযোজন ও বিয়োজন লক্ষ্য করা যায়। এ সংযোজন ও বিয়োজন প্রক্রিয়া এখনো অব্যাহত আছে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক জারিকৃত প্রজ্ঞাপনে প্রদত্ত মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা এবং তদসংশ্লিষ্ট বিশ্লেষণ পর্যালোচনায় দেখা যায়, সংজ্ঞা ও বিশ্লেষণ হতে মুক্তিযুদ্ধকালীন গ্রাম-বাংলার সাধারণ জনমানুষের অন্তর্ভুক্ত যে সকল পরিবার নিজেদের জীবনকে তুচ্ছ গণ্যে মৃত্যুর ঝুঁকি মাথায় নিয়ে খাদ্য, পথ্য, তথ্য, বস্ত্র, আশ্রয় ও অর্থ দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করায় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসর কর্তৃক হত্যা, লুণ্ঠন, বাড়ি-ঘরে অগ্নিসংযোগের কারণে চরমভাবে নিগৃহীত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন তাদের এবং যারা দেশের অভ্যন্তরে প্রশিক্ষণ নিয়ে অভ্যন্তরীণভাবে অস্ত্র সংগ্রহ করে প্রতিরোধ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন তাদেরও বাদ দেওয়া হয়েছে। এদের সহযোগিতার কারণেই মুক্তিযুদ্ধ স্বল্পতম সময়ের মধ্যে সফলতা পেয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা হতে এদের বাদ দেওয়া মুক্তিযুদ্ধকেই অবমাননার সামিল। তাছাড়া সংজ্ঞার মধ্যে তাদের অন্তর্ভুক্তি না করার কারণে সংজ্ঞাটি যে অসম্পূর্ণ এটি স্পষ্টত প্রতিভাত। আর তাই দীর্ঘদিন যাবত মুক্তিযোদ্ধা শব্দটি সংজ্ঞায়িত না করায় যে বিতর্কের অবসান হয়নি বর্তমানে সংজ্ঞাটি অসম্পূর্ণ হওয়ায় সে বিতর্কের অবসান নয় বরং নতুনভাবে সূচনা হয়েছে।
লেখক: সাবেক জজ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
সম্পাদনা: আশিক রহমান